কলকাতা ব্যুরো: শতাব্দী ব্যাপী দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষ করে এই বছরেই রাম মন্দির সংক্রান্ত বিতর্কিত জমির ফয়সালা হয়েছে শীর্ষ আদালতে। ২৮ বাদে এবার রায় হতে চলেছে বাবরি মসজিদ ধ্বংস সংক্রান্ত মামলার। ৩০ সেপ্টেম্বর ওই রায় ঘোষণা হবে। যদিও এই রায় লখনৌ এর সিবিআই বিশেষ আদালতের। রায়ের বিরুদ্ধে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং তারপরে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবুও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা আদৌ কি সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পিত? এর পিছনে কি সত্যিই প্রত্যক্ষ মদত ছিল লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলী মনোহর যোশী সহ তাবড় বিজেপি ও সংঘ নেতাদের ? গত তিন দশক ধরে এই প্রশ্নগুলোও বারবার আলোড়িত করেছে ভারতের রাজনীতির মূল ধারাকে।
আসুন এক ঝলকে দেখে নিই এই দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের গতি প্রকৃতি :
১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর দুটি এফআইআর দাখিল করা হয় অযোধ্যা পুলিশ স্টেশনে।
১) FIR no 197/92 – বিতর্কিত কাঠামো ধ্বংসের অভিযোগে লক্ষাধিক করসেবক এর বিরুদ্ধে।
২) FIR no 198/92 – উস্কানিমূলক বক্তব্য ও প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ৪৮ জন বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে।
করসেবকদের বিরুদ্ধে মামলাটি সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিলেও সংঘ পরিবারের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে মামলাটির তদন্ত নিজেদের হাতেই রাখে উত্তরপ্রদেশের সিআইডি। পরে কেন্দ্রের নরসিমা রাও সরকার দ্বিতীয় মামলাটিও তুলে দেয় সিবিআইয়ের হাতে।
১৯৯৩ সালের ৫ অক্টোবর প্রথম চার্জশিট দাখিল করে সিবিআই। লালকৃষ্ণ আডবানি, জোশি, বিনয় কাটিয়ার, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং সহ মোট ৪৮ জন নেতা-নেত্রীকে অভিযুক্ত করা হয়।
১৯৯৬ সালে অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিল করে সিবিআই। বৃহত্তর ষড়যন্ত্র, পরিকল্পিত আক্রমণের অভিযোগ যুক্ত করে ১২০(বি) ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের ধারা যোগ করা হয় তাদের বিরুদ্ধে।
১৯৯৭ সালে লখনৌর ম্যাজিস্ট্রেট বিস্তারিত চার্জশিট দাখিল করতে বললে অভিযুক্তদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্ট স্থগিতাদেশ দেয়। এরপর টানা চার বছর থমকে ছিল মামলা। ২০০১ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আডবাণী সহ অন্যান্য নেতাদের বিরুদ্ধে অপরাধ মূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে দেয়। এরপর ঢিমেতালে দুটি আদালতে দুটি মামলা চলতে থাকে প্রায় ১০ বছর। করসেবকদের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি চলছিল লখনৌ এর আদালতে, অন্যদিকে সংঘের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা চলছিল রায়বেরিলি আদালতে।
২০১১ সালে সিবিআই-র সুপ্রিমকোর্টে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুটি মামলা একত্রিত করার সিদ্ধান্ত জানায় শীর্ষ আদালত। এরপর একাধিক রিভিউ পিটিশন দাখিল হওয়ায় মামলা কাজ থমকে ছিল সাত বছর।
২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিলএই মামলা সংক্রান্ত চূড়ান্ত নির্দেশিকা জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। আডবানিদের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র সহ যাবতীয় অভিযোগ পুনর্বহাল করা হয়। করসেবক ও নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে দুটি মামলা একত্রিত করে লখনৌ এর সিবিআই বিশেষ আদালতে শুনানি শুরুর নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রতিদিন শুনানি করে দু’বছরের মধ্যে ট্রায়াল শেষ করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। ইতিমধ্যেই ৪৮ জন অভিযুক্তের মধ্যে অশোক সিঙ্ঘল, শিবসেনা প্রধান বাল থাকারে সহ ১৬ জন প্রয়াত হওয়ায় বাকি ৩২ জনকে অভিযুক্ত তালিকায় রেখে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সমস্ত অভিযুক্তকে জামিন পেতে গেলে আদালতে হাজিরা দিতে হবে এমন নির্দেশও দেয় শীর্ষ আদালত।
অন্যতম অভিযুক্ত উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং রাজস্থানের রাজ্যপাল থাকায় প্রাথমিকভাবে সাংবিধানিক রক্ষাকবচ পেলেও ২০১৯-এ তাকে বিচার প্রক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয় সিবিআই। ৩৫১ জন প্রত্যক্ষদর্শীকে সাক্ষী হিসেবে বিচার প্রক্রিয়ার সময় হাজির করেছে তারা। ৬০০-র বেশি তথ্যচিত্র প্রমাণ হিসেবে আদালতে জমা দেয় তারা। ভিডিও রেকর্ডিং এর মাধ্যমে লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশীদের জবানবন্দি গ্রহণ করে সিবিআই। যদিও প্রত্যেকেই তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এমনকি জবানবন্দি রেকর্ড করার পর উমা ভারতী প্রকাশ্যে বলেন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ক্ষেত্রে আদালত যদি তাকে অপরাধী বলে সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসি দেয়, তাহলে সেটা তার সব থেকে বড় গর্বের বিষয় হবে।
পুরো মামলায় সিবিআই এর মূল বক্তব্য, অভিযুক্তরা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ষড়যন্ত্র এবং সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং প্ররোচনা দিয়েছিলেন করসেবকদের বিতর্কিত কাঠামো ধ্বংস করতে। অন্যদিকে অভিযুক্তদের বক্তব্য এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। তৎকালীন কংগ্রেস চালিত কেন্দ্র সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে।
রায়দান এর দিন সমস্ত অভিযুক্তকে সশরীরে আদালতে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন লখনৌ এর সিবিআই আদালতের বিশেষ বিচারপতি এসকে যাদব। যদিও শারীরিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সশরীরে উপস্থিত হওয়া থেকে অব্যাহতি দিতে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছেন আদবানি, জোশি।