পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এবং বিপজ্জনক রাস্তা বলা হয় কারাকোরাম হাইওয়েকে। এই রাস্তা পাকিস্তান ও চীনকে সড়কপথে সংযুক্ত করেছে। প্রাচীন সিল্করোডের যে পথ দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে চীনের বাণিজ্য চলতো, সেই পথ ধরেই চলে পাহাড় কেটে চলে গিয়েছে কারাকোরাম মহাসড়ক। ১,৩০০ কি.মি. এই সড়কের ৮৮৭ কি.মি. পড়েছে পাকিস্তানে, বাকি ৪১৩ কি.মি. চীনে। ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কি.মি. দূরে, পাঞ্জাব প্রদেশের হাসান আব্দাল শহর থেকে যাত্রা শুরু কারাকোরাম হাইওয়ের। পাকিস্তান অংশে হরিপুর, অ্যাবোটাবাদ, গিলগিট, হুনজা, সোস্ত প্রভৃতি শহরের মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে খুনজিরাব পাস পর্যন্ত। তারপর চীন সীমান্ত পেরিয়ে তাশগুর্কান শহর ছাড়িয়ে কাশগড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে হাইওয়েটি।
১৯৬৬ সালে এই মহাসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ২১ বছর পর কয়েক হাজার টন ডিনামাইট ফাটিয়ে বিপুল টাকা খরচ করে ১৯৭৯ সালে শেষ হয় এই রাস্তা। এরপর ১৯৮৬ সালে খুলে দেওয়া হয়। হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ- এই তিনটি পর্বতমালার কোলঘেঁষে কারাকোরাম হাইওয়ের বেশিরভাগ অংশই ৩,৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত।ভূমিধস, পাথরধস, বন্যা, তুষারপাত, হিমাবাহের ধেয়ে আসা- নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বারই বিঘ্নিত হয়েছে এর নির্মাণকাজ। জীবন দিতে হয়েছে প্রায় এক হাজারের মতো শ্রমিককে। কারাকোরাম হাইওয়ে মানে পাহাড়, অকল্পনীয় উচ্চতা, রুক্ষতা, কমনীয়তা আর বিপদের আশ্চর্য সংমিশ্রণ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান-চীন সীমান্তে একটি সড়ক নির্মাণের কথা প্রথম মাথায় আসে চীনা জেনারেল জেং বিয়াও-এর। তিনি ১৯৫৬-৫৮ সালে পাকিস্তানে চীনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।তিনি কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে বেইজিংকে এই হাইওয়ে নির্মাণে অর্থ ঢালতে রাজি করান। আসলে এই পথ চীনের পক্ষে লাভজনক ছিল যে এতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ রাস্তাটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথে চীনকে আরব সাগরে পৌঁছে দিতে পারে, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওয়াদারের সঙ্গে সড়ক পথে চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সড়কটি শুধু পাকিস্তান ও চীনকে সংযুক্ত করেনি, দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরেশিয়া অঞ্চলের বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে।
কারাকোরাম হাইওয়ে এখন পর্যটন আকর্ষণই বেশি।পাহাড়ের গভীরে এই রাজপথ ধরে ছুটে চলা মানে বিপদেরহাতে হাত রাখা, রোমাঞ্চের স্বাদ উপভোগ করা আর প্রাণ ভরে মুক্তির সুবাতাস টেনে নেওয়া। প্রাচীন সিল্করোডের এই পথ ধরে চলতে গিয়ে হাজার বছর আগের পথিক, বণিক, পর্যটক, অভিযাত্রী, বিশ্ববিজয়ী বীর, দুধর্ষ খুনি বা ডাকাতদলের পায়ের ছাপ অনুসরণ করা। আঁকাবাঁকা পথ ছাড়িয়ে পথের দু’পাশে ভয়াবহ উচ্চতার দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ, অসংখ্য হিমবাহ আর নয়নাভিরাম কাশ্মীরের শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দর উপত্যকাগুলি চোখে পড়া আর বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজনের সাথে পরিচিত হওয়া।এ যেন ছোটখাট কয়েকটা দেশ ভ্রমণ।সেইভ্রমণের সময় আবহাওয়া যদি শান্ত থাকে, তারপরও পড়তে হবে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখে। দেখা যাবে, প্রশস্ত রাজপথ হঠাৎই সরু হয়ে গিয়েছে, আচমকা তীক্ষ্ম বাঁক নিয়েছে, বিশাল পাথরের নিচ দিয়ে চলে গিয়েছে রাস্তা, উপরে তাকালেই গা শিউরে উঠবে। সঙ্গে অবধারিতভাবে থাকছে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দৈব আবির্ভাব!
এই এলাকার প্রধান আকর্ষণ ছবির মতো সুন্দর উপত্যকা ফেইরি মিডো। ফেইরি মিডোর সবুজ তৃণভূমি থেকে চোখে পড়বে ৮,১২৫ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় সুন্দরী নাঙ্গা পর্বতের তুষারঢাকা চূড়া। গিলগিট শহর থেকে রায়কোট ব্রীজ পেরিয়ে ফেইরি মিডো যাওয়া যায়। এরপর মিনাপিনে সাক্ষাৎ ঘটবে কারাকোরাম পর্বতমালার অন্তর্গত দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের আরেকটি রাকাপসি (৭,৭৮৮ মি.)। রাকাপসিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হিমবাহ চোখে পড়ে। হুনজা ভ্যালিতে যাওয়ার পর শিয়া জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনযাত্রার সঙ্গে উপভোগ করা যায় মনোমুগ্ধকর সবুজ উপত্যকার সৌন্দর্য, করিমাবাদ শহরের প্রাচীন দুর্গ আর পাসু পর্বতমালা। সোস্ত শহর পেরোলেই ফুরিয়া আসে পাকিস্তান সীমানা, তারপর চীন। এরপর স্বাগত জানায় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বর্ডার ক্রসিং খুনজিরাব পাস (৪,৮০০ মি.)। কুনুলুন, তিয়েনশান, হিন্দুকুশ, হিমালয়, কারাকোরাম- পৃথিবীর পাঁচটি বৃহত্তর পর্বতমালা মিশেছে খুনজিরাব পাস এলাকায়। চীন, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তানের সীমান্তও মিলিত হয়েছে এখানে।