ঢাকের বাদ্যি, গুরুগম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ, আলোকমালায় সেজে ওঠা মণ্ডপ কিংবা প্যান্ডেল কোনোটাই নেই। কিন্তু জামাই ষষ্ঠী থেকে অনেকটা চুপিসাড়ে আরও একটি দুর্গা পুজো হয়ে আসছে। অবশ্য দুর্গাপুজো না বলে বলা ভালো মহিষমর্দিনী পুজো। দুর্গাপুজো এবং বাঙালি এই কথা দুটি এখন একই মুদ্রার দুটি পিঠের মতো। একটির সঙ্গে অন্যটির অস্তিত্ব ও সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ম্লান হলেই বোধহয় গোটা জাতি পরিচয়হীনতায় ভুগবে। কিন্তু সেটা বললেও যথেষ্ট বলা হবে না। দুর্গা পুজো মানে শরৎকালের শারদীয়া দুর্গোৎসব বোঝায়। আপামর বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো বললে শরৎকালের শিউলির গন্ধমাখা পরিবেশে নতুন করে সেজে ওঠা। তবে এখানে একটি অন্য ধরনের অন্যরকম দুর্গাপুজোর কথা যা কিনা মহিষমর্দিনী পুজো নামে পরিচিত।
বাঙলার হুগলি জেলার চুঁচুড়ার ধরমপুরে বিগত প্রায় সাড়ে-তিনশো বছর ধরে প্রতিবছর জামাই ষষ্ঠী থেকে শুরু হয়ে দশমী পর্যন্ত চলে এই মহিষমর্দিনী পুজো। এই মহিষমর্দিনী দেবীর নামানুসারেই এই জায়গার নাম “মহিষমর্দিনী তলা”। প্রায় ৩৫০ বছর অনেকে বলেন এই মহিষমর্দিনী পুজো ৬০০ বছরের প্রাচীন। জানা যায় প্রাচীনকালে এখানে একটি ছোটো মন্দির ছিল। সেখানেই দেবীর পুজো করা হত। কিন্তু বর্তমানে এখানে খুব সুন্দর একটি নাটমন্দির রয়েছে যার নির্মাণ কাজ ১৯৭৭ সালে শুরু হয়ে ২০১৮ সালে সম্পূর্ণ হয়।
দেবী মহিষমর্দিনী দশভূজা, সিংহবাহিনী, মহিষাসুর নিধনে উদ্যত। তাঁর দক্ষিণে মহাদেব এবং বামে গনেশের অবস্থান। এই মহিষমর্দিনী জামাই ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমী পর্যন্ত অত্যন্ত জাঁকজমকভাবে পূজিতা হন। মূল প্রতিমার একটি ছোট প্রতিকৃতি মন্ডপে সারাবছর প্রতিষ্ঠিত থাকে। এছাড়া সর্বদক্ষিণে হনুমানের একটি মূর্তি দেখা যায়। বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব শিথিল হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়ার এই জায়গাতে হিন্দুধর্মের অন্যতম দেবতা ধর্ম ঠাকুরের পুজো করা হত। সেই ধর্ম ঠাকুরের নামানুসারেই পরবর্তীকালে চুঁচুড়ার এই জায়গার নাম হয় “ধরমপুর”। তারপর শাক্তধর্মের প্রভাবে এখানকার মানুষ শক্তিসাধনায় আগ্রহী হয়ে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে এখানে শুরু হয় মহিষমর্দিনী পূজা। পূজার শেষে এখন গঙ্গায় প্রতিমা নিরঞ্জন করা হলেও আগে তা করা হত স্থানীয় পুকুরে।
পূর্ব বর্ধমানের কালনায় মহিষমর্দিনী পুজো হয় বর্ষার ঘনঘটার মধ্যেই। তিথি অনুযায়ী, সপ্তমী থেকেই দূর্গা পুজোর মতো চার দিন সারম্বরে পালিত হয় এই বিশেষ পুজো। কালনার এই পুজোকে ঘিরে এলাকায় বসে মেলা। কালনায় মহিষমর্দিনী পূজোকে ঘিরে চারদিন কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। অন্যদিকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে মহিষমর্দিনী পুজোর প্রচলন রয়েছে রানাঘাটের বড়বাজার এলাকাতে। কথিত আছে কুমার ষাটপুরের জমিদারের ব্যবসা ছিল রানাঘাট বড়বাজার এলাকাতে। তিনিই এই পুজোর প্রচলন করেন। পরবর্তীতে রানাঘাটের পালচৌধুরী জমিদারবাড়ির সদস্যরা এই পুজো চালিয়ে গিয়েছেন। এক সময় রানাঘাটের এই অংশে নদীপথে বাণিজ্য হতো। বহুদূর থেকে এই বড়বাজারে আসতেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু কোনও অজানা কারণে মাঝে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিমার কাঠামোটি নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কাঠামো ভাসতে ভাসতে কালনায় ওঠে আর তারপর কালনাতেও এই পুজো শুরু হয়। এখন কালনা এবং রানাঘাট এই দুটি এলাকাতেই মহিষমর্দিনী পুজোর প্রচলন রয়েছে।