আরব্য রজনীর ‘আলি বাবা আর চল্লিশ চোর’ গল্পতে আছে ডাকাত সর্দার যখন কারও বাড়িতে ডাকাতি করতে যেত, তখন সে নাকি ওই বাড়িতে নুন খেত না। কারণ নুন খেলে সে আর নেমক হারামি বা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে না। আলিবাবার পরিচারিকা মর্জিনা সেটা ধরে ফেলেছিল অতিথি আসলে ছদ্মবেশী ডাকাত। কিন্তু কবে থেকে মানুষ এই লবণের ব্যবহার শিখলো? জানা যায় কয়েক হাজার বছর আগে থেকে মানুষ খাবারে লবণের ব্যবহার করছে। তবে তখনকার লবণ আজকের মতো সমুদ্রের জল থেকে তৈরি করা লবণ নয়। তখন লবণ সংগ্রহ হত খনি থেকে। চীনের সানশিতে ইয়নচুনে নামে এক লবন খনির কথা জানা যায়। পরবর্তীতে পোল্যান্ড, তুরস্ক, বলিভিয়াসহ আরও অনেক দেশে লবণ খনির দেখা মেলে। আস্ট্রিয়ার একটি এলাকার নাম সালজবুর্গ যার মানে হলো লবণের শহর। লবণের খনিটি সতেরো কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। ইতালির দক্ষিণে সিসিলিতে ডোরাকাটা লবণের খনি আছে। যেটি প্রায় ২০ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে।
৫ হাজার বছর আগে ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৩০০ ফুট নীচে লবণ খনির খোঁজ পাওয়া যায় তুরস্কে। এখনও এখান থেকে প্রতিদিন ৫০০ টন লবণ সংগ্রহ হয়। খিস্টের জন্মের ৬০০০ হাজার বছর আগেও মানুষ খনি থেকে লবণ তুলতো। খাওয়ার জন্য যে লবণ সমুদ্র থেকে আসে সাধারণ তা দেখতে সাদা কিন্তু খনির লবণ বিভিন্ন রঙের হতে পারে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় কালো লবণ পাওয়া যায়। এর বেশির ভাগ পাওয়া যায় ভারতে। এটি মূলত খনির লবণ। এর মধ্যে রয়েছে সোডিয়াম ক্লোরাইড, আয়রন, সালফার কম্পাউন্ড। রান্নার স্বাদ বাড়াতে অনেক সময় এই ব্ল্যাক বা কালো লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
অনেক বছর আগে থেকেই খাওয়ার পাশাপাশি আরও নানা কাজে লবণের ব্যবহার হয়ে আসছে। হাজার হাজার বছর আগে প্রাচীন মিশরীয়রা লবণকে পবিত্র বলে মনে করত। তাই তারা কবরে লবণ রাখত। মৃতদেহ লবণ দিয়ে মাখালে তা টিকে থাকে অনেকদিন। তাই তারা মৃত মানুষের কবর দেওয়ার সময় লবণ রেখে দিত। মিশরীয়রাই লবণ মাখিয়ে খাবার সংরক্ষণ করার উপায় বের করেছিলেন। তারা মাছে লবণ মাখিয়ে বিক্রি করতো ফিনিশিয়দের কাছে। লবণের নানান ধরনের ব্যবহারের ফলে লবণের ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। লবণ বিক্রির জন্য আফ্রিকায় একটি আলাদা রাস্তা তৈরি হয়েছিল। সেই রাস্তা আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মধ্যে দিয়ে গেছে। এই রাস্তা দিয়ে টুয়ারেগ নামের এক জাতি বছরে প্রায় ১৫০০০ টন লবণ নিয়ে যেত। লবণের ইতিহাস শুধু খাওয়ায় লবণের ব্যবহার বা লবণ নিয়ে বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতন দেওয়া হত লবণ দিয়ে। ইংরেজিতে ‘সোলজার’ মানে হলো সৈন্য আর সেলারি মানে বেতন। এই দুটি শব্দ এসেছে ‘সল্ট’ থেকে। আজ আমরা যে সালাদ খাই সেই শব্দটিও এসেছে সল্ট থেকে সল্টেড হয়ে।
লবণ নিয়ে একটি আন্দোলন হয়েছিল- লবণ আইন অভিযান বা লবণ সত্যাগ্রহ, ইংরেজিতে সল্ট মার্চ। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই লং মার্চের আহবায়ক ছিলেন স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী। লবণের উপর ব্রিটিশ সরকার যে কর আরোপ করে তারই প্রতিবাদে এই যাত্রার আয়োজন করা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই দিন গান্ধীজির যাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন। অনেক ধর্মে লবণ খুব পবিত্র ব্যাপার। জাপানের শিন্টোরায় যে কোন মানুষ বা স্থানকে পরিশুদ্ধ করতে লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। যে কারণে সুমো কুস্তীগিরদের উপর লবণ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। লবণ যে শুধু মানুষের জীবনে কল্যাণ বয়ে এনেছে তা তো নয়, অনেক যুদ্ধও কিন্তু এই লবণের কারণে হয়েছিল। ইতালির ভেনিস শহরের সঙ্গে জেনোয়া নামের একটি শহরের লড়াই হয়েছিল শুধুমাত্র লবণকে কেন্দ্র করে। ১৮০০ সাল নাগাদ যখন ইংল্যান্ডের এক জায়গায় লবণ পাওয়া যায়। সেই লবণ সরবরাহ করতে গিয়েই লিভারপুল নামে এক বিশাল বন্দর গড়ে ওঠে।
আলেকজান্ডার তখন পৃথিবী জয়ের লক্ষ্য নিয়ে ভারতের দিকে এগোচ্ছেন। পাকিস্তানের ঝিলাম নদীর কাছে বড়ো বড়ো পাথরের সামনে তার ঘোড়াগুলি দাঁড়িয়ে পড়ে। আর ঘোড়াগুলি এক রঙের পাথর চাটতে থাকে। সেখান থেকে পরে সৈন্যরা আবিষ্কার করে সেই পাথর কোনো সাধারণ পাথর নয়, তা ছিল নোনতা স্বাদের পাথর। ঠিক ওই সময় আবিষ্কৃত হয় পিঙ্ক সল্ট। জীবনের জন্য লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। লবণে আছে বিপুল পরিমাণ সোডিয়াম। সোডিয়াম শরীরের জন্য দরকারি ইলেক্ট্রোলাইট। জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত ইলেক্ট্রোলাইট, সোডিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ক্যালসিয়াম অপরিশোধিত লবনে পাওয়া যায়। শরীরে লবণ বেড়ে যাওয়া বা লবণের পরিমাণ কমে যাওয়া দুটিই দেহের জন্য বিপজ্জনক। তাই লবণের সঙ্গে বন্ধুত্বটাও বেশ সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়।