রায়মঙ্গল আর বিদ্যেধরীর সীমানা শরীর কিছুই আলাদা করা গেলনা। মোটরবোটের পাটাতন থেকে কিছুটা লম্ফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে বড়তুষখালির জেটিতে দাঁড়ালাম। ভাঙ্গাতুষখালি একটু আগেই পেরিয়েছি তার আগে সন্দেশখালির বিস্তৃত সড়ক জেটিঘাট। চল্লিশের বেশী তাপমাত্রা হাঁসফাঁস করা শরীরের হাল। কিন্তু এবার যে দীর্ঘ ভাঙ্গাচোরা বাঁধের পাড় গ্রামের ঘর আর ভেড়ির গা ঘেঁষে হাড় আর খিল আলাদা করে দেওয়ার মতো রাস্তায় সন্দেশখালির দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়ন পেরোতে হবে সেটা অতটা জানা ছিলনা। মানে জানানো হয়নি। কিছু কিছু আগাম জেনে ফেলা আবার ব্যাপারটা ম্যাড়ম্যাড়ে করে দেয়। তাই যত দেখেছি নতুন করে জেনেছি। ওই যে জন্মসূত্রেই আমি ঋণী আমার খুঁজে পাওয়া অভিজ্ঞতার কাছে! শেষে পথ শেষ করেছিলাম চরার জমিতে খাল পেরিয়ে একটা ফাটলধরা সিমেন্টের রাস্তায় পা ফেলে। অর্থাৎ ওই পড়শী জমি জিরেত এবার দক্ষিণের আওতায়, গোসাবা। পথে মাঠে বাজারে নদীর পাড়ে চায়ের দোকানে মানুষের নিকোনো উঠোনে যেটুকু দেখেছি ঘুরেছি সেসব ব্যাক্তিগত কষ্ট আর ডিসকমফোর্টের পরেও ফেলে দেওয়ার নয়। অভিজ্ঞতা যে আমাকে ঋণী করে রাখে। বেশি কিছু বোধয় খুলে উপুড় করে এক্ষুনি না দেওয়াই ভালো। ব্যক্তিগত রোজনামচায় ধরে রেখেছি।
বসেই ছিলাম। বেলা বাড়ার সঙ্গে শরীরে ঘিলুতে অলস মন্থর সময় উচ্চারণ হচ্ছে। অর্থাৎ কিছুই বলছিনা ভাবছিনা নিষ্ক্রিয় হয়ে আছি। অনেকটা সময় বাঁচার পরে যে নুয়ে যাওয়া সময়টা সেটা ঠিক এই গরমে প্রাক মধ্যাহ্নে দেখা দেয়। কোন যতিচিহ্ন না দিয়েও আমরা কমা সেমিকোলন হাইফেন লাগিয়ে বাকিটা যেভাবে এগিয়ে যাই অনেকটা সেরকম। সামনের দেওয়াল আসবাব জুড়ে খাটের বাজুতে টেবিলক্লথে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে অলস স্থবির সময় এখন। এমনকি পাশেরবাড়ির ছাতের সবুজ ট্যাংকেও ওই একই ইঙ্গিত। অদৃশ্য ভেসে থাকা বাতাসেও। গ্যাসস্টোভে চাপানো হাঁড়িতে ভাত ফোটার একটানা ছন্দ কানে আসছে শুধু। ভালো লাগে। এখন আমি একা তাই ভাত ফোটার ওই শব্দে আমি সজাগ, এক শৃংখলিত যত্নের দিকে নিবিড় করে রাখে। নিয়মের মধ্যে বেঁধে রাখে। স্নানের, খিদের কথা মনে করায়।
ফুটে ওঠা ভাতের গরম হাঁড়ি জঠর মনস্ক করে, আহারের ও স্বাদের কথা ভাবায়। আগুন তাকে পাচন উপযোগী করে তোলে আমার নজরদারিতে। দরজা পেরিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে নজর হয় নানা তাকে চাপানো অসংখ্য ধাতুর কাচের প্লাস্টিকের কৌটো পাশেই সারি সারি বাসনের দিকেও শুকিয়ে ওঠা একরকম স্থবিরতা অটুট লেগে আছে লক্ষ করি। শুধু গলন্ত ভাতের ফুটে চলা অস্থিরতা ছাড়া আমি কিছুই ক্রিয়াশীল দেখিনা তখনও, এমনকি টগরের সরু ডালে লেগে থাকা পাতাতেও। স্টোভের চাবি ডানদিকে মোচড় দিয়ে বন্ধ করে আমি আবার চেয়ারে বসে পড়ি। দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা তিনটে ঘুরছে সেকেন্ডেরটা শুধু চোখে পড়ে, ওটার শব্দ টের পাই। তারপর সিলিং ফ্যানের সুইচ দিই। ঘুরতে শুরু করলে আমি পায়চারি করি আলতো পা ফেলে ঘরের মধ্যেই একটু একটু করে সমস্ত যান্ত্রিকতা সায় দেয় সচল হয় আমার মাথা আমার পরবর্তী কর্মসূচি। কলে জল পড়ার শব্দ আসে প্লাস্টিকের টাবে।
বুঝি বাইরে মানুষ ব্যস্ত দায়িত্ববান ঠিকই তাদের তাদের কাজ করে যাচ্ছে যেভাবে মহাকাশের কক্ষপথে সূর্য একটু একটু করে দিক বদলে হেলে যেতে থাকে অচেনা বায়ুমণ্ডলে। তাতেই রোদে তেতে ওঠে পাঁচিল কালো দরজা তারে মেলে দেওয়া পাজামা গামছা সংসারের অন্যান্য সম্ভ্রম। সভ্যতার টুকরো টুকরো কয়েকটা ক্রমশ ছিঁড়ে ওঠা আড়াল। আমি চপ্পল পায়ে গরম উঠোনে দাঁড়াই। দেখি অনেকটাই এগিয়ে আসতে পেরেছি কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তটা যেভাবে ছিলো তার থেকে। ক্যালেন্ডার পাক খেয়ে সাধে কী আসে নববর্ষ? সময় দিন সন গণনা জারি আছে কবে থেকে, একটুও থামেনি। সংক্রান্তিতে চড়ক গাজন বাণফোঁড়ার দিনে আমারও শিবের ভস্ম মেখে কিছুটা টালমাটাল হতে ইচ্ছে হয় আজ বিকেলের আগেই।