প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া এই মানুষটির প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা। তখন তা ছিল মহামারীর সমান। ১৯৫৫ সালে মারা যান এই অভিনেত্রী। জন্মেছিলেন ১৮৭৫ সালে। দরিদ্র পরিবারে কোনও রকমে বেড়ে ওঠা চুনিবালার কাছে অভিনয় ছিল শখ বা বিলাসিতা। তবু অপ্রত্যাশিতভাবেই ১৯৩০ সালে তাঁর কাছে একটি সুযোগ হাজির হয়েছিল, ‘বিগ্রহ’ নামের একটি সিনেমায় অভিনয় করার। সেই প্রথম, তারপর আরও একটি বড় সুযোগ, ১৯৩২ সালে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় ‘নটীর পূজা’তে মঞ্চে অভিনয় করেন তিনি। এরপর ১৯৩৯ সালে ‘রিক্তা’ নামে আরও একটি সিনেমায় অভিনয় অভিনয় করেন তিনি। ব্যস ওই পর্যন্তই। তার পরে আর অভিনয় করা হয়নি। কেউ তাঁকে অভিনয় করার জন্য যোগ্য মনে করেননি, সুযোগও দেননি। কেউ আর তাঁর কোনো খবর রাখেননি, কোথায়, কেমন করে বেঁচে আছেন তিনি। রাখবেনই বা কেন।
শেষ বয়সে কলকাতার নিষিদ্ধ পল্লির এক গলির এক কোণে কোনও মতে দিন কাটাতেন বৃদ্ধা চুনিবালা। কিন্তু জানতেন না, সেই অন্ধকোণ থেকে শেষ বয়সে একদিন তাঁর আলোয় ফেরা সম্ভব হবে। সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ ব্রিটিশ বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিজে কিমার-এর ভিজ্যুয়ালাইজার বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘পথের পাচালী’ সিনেমায় রূপ দেবেন। তাঁর সমস্ত চরিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রী ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে কেবল আটকে রয়েছেন ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কাউকে পাচ্ছেন না।তিনি হয়রান হয়ে খুঁজছেন তেমন একজন বৃদ্ধাকে যিনি ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে মানানসই। খুঁজে খুঁজে আশা যখন প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তখন অভিনেত্রী রেবা দেবী, যিনি ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে ধনী প্রতিবেশী, মিসেস মুখার্জির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তিনি সত্যজিৎ রায়কে চুনিবালা দেবীর নাম সুপারিশ করেছিলেন। একজন প্রাক্তন থিয়েটার অভিনেত্রী, চুনিবালা দেবীকে অনুসন্ধান করতে হবে কলকাতার কুখ্যাত রেড লাইট এলাকা সোনাগাছিতে। সত্যজিৎ ইন্দির ঠকুরনের খোঁজে সেখানেই পউছে যান।নানা অলিগলি, এঘর সেঘর আতিপাতি তল্লাশি চালিয়ে অবশেষে যার দেখা মিললো তিনিই চুনিবালা এবং অবশ্যই ইন্দির ঠকুরণ। সত্যজিৎ তো আবিস্কারের আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন। অন্যদিকে প্রস্তাব শুনে তো অবাক বৃদ্ধা চুনিবালা।
সারা জীবন হয়তো অতি সামান্য কিছুর জন্যই অপেক্ষা করেছেন কিন্তু পেলেন অনেক কিছু যদিও তা এই শেষবেলায় পৌঁছে! তাও আবার সত্যজিৎ রায়ের মতো একজন শিল্পীর কাছ থেকে! আপ্লুত বৃদ্ধা তখন পরিচালককে তাঁর জমিয়ে রাখা সম্পত্তি দেখাতে শুরু করেছেন। কী সেই সম্পত্তি? তাঁর করা গুটিকয়েক সিনেমার পোস্টার। ইন্দির ঠাকরুনের চরিত্রে অভিনয় করতে চুনিবালার অভিনয় নারাজ হবার তো কথাই নেই। উপরন্তু ঠিক হল, রোজ ২০ টাকা করে পারিশ্রমিক তিনি পাবেন পরিচালকের তরফে। শ্যুটিং-এর জন্য যথেষ্ট টাকা পয়সা নেই কিন্তু এটুকু তো করতেই হয় তাঁর জন্য। এটা ছিল সেদিনের ভাবনা, রীতিও বলা যায়, আজ এমনটা মাথা খুঁটেও মিলবে না। কেবল যে কুড়ি টাকা তাতো নয়, চুনিবালার যাতায়াতের কথাও ভেবেছিলেন সত্যজিৎ, সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করেছিলেন। যাই হোক শ্যুটিং শুরু হল। চুনিবালা তাঁর কাজে সকলকে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন। বৃদ্ধার মনোবল, নিষ্ঠা দেখেতো পরিচালক স্বয়ং শটের শেষে কাট বলতেও ভুলে গিয়েছিলেন। রুগ্ন শরীর, অসুস্থ, তবুও কী প্রবল জেদ চুনিবালার! ছবির শিল্প নির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্ত একটি সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি অবাক হতেন চুনিবালা দেবীর অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ এবং ধারণা দেখে। চরিত্রের সাজপোশাক কেমন হবে তার সম্পর্কেও দারুণ ধারণা ছিল অশীতিপর চুনিদেবীর।
তার পরেই আসে সেই অন্যতম মনে রাখার মুহূর্তটি। বৃদ্ধা ইন্দির ঠাকুরনের ‘হরি দিন তো গেল, সন্ধে হল’ গান, আর তার পরে ওই ভাবেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার দৃশ্য। নিজের সারা জীবনের জমে থাকা সব বেদনা যেন উজাড় করে দিয়েছিলেন তিনি ওই একটি দৃশ্যের অভিনয়ে। আজও বাঙালি সেই মুহূর্তকে স্মরন করে চোখের জল ফেলে। শোনা যায়, সে মরণের দৃশ্য এতই জীবন্ত হয়ে উঠেছিল, যে সিন শেষ হওয়ার পরেও সকলে স্থবির হয়ে গেছিলেন বেশ কিছুক্ষণের জন্য। তবে জীবনের সেরা কাজ করা সেই অসামান্য ছবি মুক্তির পরে বড় পর্দায় দেখে যাওয়া হয়নি তাঁর। কুড়োনো হয়নি প্রশংসা, পাওয়া হয়নি সম্মান। পর্দার ইন্দির ঠাকরুনের মতোই বাস্তবের চুনিদেবীও চলে গিয়েছিলেন চিরঘুমে। তবে একটাই সান্ত্বনা, ‘পথের পাঁচালি’ মুক্তির আগেই চুনিদেবীকে আলাদা করে সিনেমাটি দেখিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় নিজে। কেবলমাত্র চুনিবালার জন্যেই তিনি প্রোজেক্টর মেশিন নিয়ে তাঁর ঘরে ছবির রিলগুলি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। এর তিন বছর পরেই আসে আন্তর্জাতিক সম্মান। বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হয় চুনিদেবীর অভিনয়। সারা জীবনের শেষে আলোর মুখ দেখলেও, সে আলোয় তিনি আর বাঁচার সুযোগ পাননি।
বিভূতিভূষণের উপন্যাসে বা সত্যজিতের চিত্রনাট্যে ইন্দির ঠকুরনের গানের উল্লেখ ছিল না, কিন্তু কিজানি পরিচালকের মনে হয়েছিল, ইন্দিরের কোনো অলস মুহূর্তে তাঁর গাওয়া একটি গান দিতে পারলে মন্দ হয় না। চুনিবালার অনেক গুণের মধ্যে তাঁর সুরেলা কন্ঠ আবিষ্কার হয় বেশ পরের দিকে। এক দিন সুটিং-এর শেষে হরিহরের দাওয়ার বসে বৈকালিক চা-পানের সময় সত্যজিৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি গান জানেন? চুনিবালা তখন বলেছিলেন- “ধর্মমূলক চলবে কি?” সত্যজিৎ বলেছিলেন, চলবে। তখন চুনিবালা গেয়েছিলেন- “মন আমার হরি হরি বল/ হরি হরি হরি বলে/ ভবসিন্ধু পার চল”। গানটি রেকর্ড হয়েছিল, কিন্তু ছবিতে ব্যবহার হয়নি। তার বদলে আমরা ইন্দির ঠাকরুণকে অন্য গান গাইতে শুনেছি। সেই ঘটনাটি এই রকম- সেদিন চাঁদনি রাত। দাওয়ায় বসে হাতে তাল রেখে ইন্দির ঠাকরুন গান করছেন। এমন দৃশ্য যখন উল্লেখিত গানটি সহ তোলা হবে তখন শট নেওয়ার কিছুক্ষণ আগে চুনিবালা দেবী বললেন, তাঁর আরেকটা গান মনে পড়েছে। সেটা নাকি আরও ভালো। চুনিবালা সত্যজিতকে প্রশ্ন করলেন, “শুনবেন?” শুরু হল তাঁর গান। “হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল/ পার কর আমারে”।