সমতল থেকে ৮ হাজার ফিটেরও বেশি উঁচুতে, নিচের দিকে খাড়া পাহাড়ি খাদ। মানুষ পাহাড়ের চূড়ার প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে এক অন্যরকম আবাসস্থল গড়ে তুলেছে এখানে। ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া শীতের পোশাক ভেদ করে শিরশিরে এক অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে শরীরে। মানুষ কেবল মানুষকেই ভালোবাসে না; মানুষ প্রকৃতিও ভালোবাসে। যে কারণে প্রকৃতির একটু পরশ পেতে দূরদূরান্ত থেকে আমাদের মতো হাজারও মানুষ ছুটে আসে এই শহরে।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিকিমের রাজার থেকে দার্জিলিং অধিগ্রহণ করে এবং এই অঞ্চলের উন্নয়ন করে, প্রথম চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে। মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরেই দার্জিলিং শহরের দর্শনীয় স্থান আর বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে। শহরের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে অন্যতম টাইগার হিল, রক গার্ডেন, চিড়িয়াখানা, বাতাসিয়া লুপ, মহাকাল মন্দির, নেপালি কবি ভানু ভক্তের মূর্তি, হ্যাপি ভ্যালি ট্রি স্টেট, পৃথিবীর অন্যতম উঁচু রেল স্টেশন ঘুম। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত সুউচ্চ দার্জিলিং শহরে রয়েছে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বিখ্যাত বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেন্ট পলস স্কুল, সেন্ট জোসেফ স্কুল, দিল্লী পাবলিক স্কুল, আছে আরও অনেক বিখ্যাত স্কুল। বিশাল উচ্চতায় অবস্থিত এই দার্জিলিং শহরে শপিং মল, ক্যাসিনো, সিনেমা হল, ভিডিও পার্লার, সাইবার ক্যাফে, জামাকাপড় ও ইলেকট্রনিক্সের দোকান ইত্যাদি আধুনিক শহরের সব উপাদানে ভরপুর এ শহর। দার্জিলিং শহর ও তার আশপাশের দ্রষ্টব্য এতই বেশি যে সাইটসিয়িং করতে অন্ততপক্ষে তিন চার দিন সময় লাগবেই। সিকিম ও নেপালজুড়ে অবস্থিত বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা নিয়ে অনেক গল্পকথা শুনেছি। সারা বছর ধরে বরফে ঢাকা থাকে পর্বতশৃঙ্গটি যার কারণে লোভ সামলাতে পারলাম না। হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার অনুপম সৌন্দর্য ও চিত্তাকর্ষক সূর্যোদয় দেখার জন্য রওনা হলাম ভোররাতে। আকাশে চাঁদ নেই তবে ঠান্ডা আর কুয়াশার দাপট চলছে তাই চারদিকে খুব অন্ধকারাচ্ছন্ন। গাড়ির ড্রাইভার হেড লাইট জ্বালিয়ে রাস্তার দু’ধারে গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ি উঁচু রাস্তা ধরে চলছে টাইগার হিলের দিকে। গাড়ি বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বাঁক নেয়ার সময় হেড লাইটের আলো গিয়ে যখন পড়ছে নিচের পাহাড়ি খাদের কিনারায়।
যখন টাইগার হিল এসে পৌঁছালাম তখনও রাত্রির কালো আঁচলের তলায় পুরো পাহাড়ি অঞ্চল যেন চাপা পড়ে আছে। শত-শত গাড়ি আর বিপুলসংখ্যক পর্যটক এখানে ভিড় করেছে। কনকনে ঠান্ডায় সবাই গাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে পায়ে হেঁটে টাইগার হিলের চূড়ার দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সূর্যোদয়ের সময় কাঞ্চনজঙ্ঘা যখন তার রূপের ঝিলিক দেখাবে তার দশ-পনের মিনিট আগেই টাইগার হিলে গিয়ে পৌঁছাবে। হিমালয় পর্বতমালার পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ যার উচ্চতা ২৮ হাজার ফুটের অধিক। আর আমাদের অবস্থান টাইগার হিলের উচ্চতা ৮৪০০ ফুট। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া হয়ত এত উঁচুতে যে, হয়ত আকাশের কাছাকাছি গিয়ে মিশে যাবে। ৬টা বাজার আগে টাইগার হিলে গিয়ে পৌঁছে মনে হল, কিছুক্ষণের মধ্যে যখন সূর্যোদয় হবে তখন বরফে ঢাকা পর্বতের চূড়া সাদা থেকে ক্রমে আকাশের রংয়ের সাথে মিলে নীল হয়ে উঠবে, তারপর নীল রঙ ধীরে-ধীরে চোখ ঝলসানো সোনালী কিংবা গোলাপি রঙে রঙিন হয়ে উঠবে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জবুথবু অবস্থার মধ্যেও প্রশান্তির সূর্যরশ্মি উঁকি দেবে পূর্ব আকাশে এই আশায় আমাদের মতো হাজারও মানুষ প্রতীক্ষার গ্রহর গুনছে। কিছুক্ষণ পর সূর্যের ধবধবে ফর্সা আলো কুয়াশার চাদর সরালেই কাঞ্চনজঙ্ঘা ভেসে উঠবে চোখের সামনে। কিন্তু না, ঘন কুয়াশার কারণে দৃষ্টির সীমানা কিছুদূর গিয়েই আবার যেন ফিরে আসছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার আশার আলো। ঘন কুয়াশার কারণে হিমালয় কন্যা কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা মিললো না।
টাইগার হিল ছেড়ে গাড়ি এগিয়ে চলল শতবর্ষের প্রাচীন আর পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনাস্থান ঘুম মোনাস্ট্রির দিকে। সূর্যের আলোর দেখা না মিললেও ঘন অন্ধকার কেটে গিয়েছে আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কিছু দুরে পাহাড়ের ঢালে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে তুলোর আঁশের মতো। চলতি পথে পাহাড়ে ঘেরা শহরটির বিভিন্ন স্থানে টিলার গায়ে ঘরবাড়ি, মন্দির, গির্জা, স্কুল, ক্লাব, হোটেল ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর ঘুম মোনাস্ট্রিতে পৌঁছালাম। উপাসনালয়ের ভেতরে সাত সকালে ধর্মচারীরা প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনায় মগ্ন। উপাসনালয়ের দেওয়ালে সেঁটে দেওয়া আছে পৌত্তলিক যুগের জীবনভিত্তিক কাহিনি থেকে নেওয়া পাথরের তৈরি কালো মূর্তি। মূর্তিগুলো প্রাচীন যুগের মানুষের ধর্মবিশ্বাসের চিন্তা চেতনাকে ফুটিয়ে তুলেছে। সত্যিই, অনেক সময় একটি খোদাই করা প্রতিকৃতি শত বছরের পিছনের হাজারো শব্দের কথা যেন একসঙ্গে বলে দেয়।
বৌদ্ধ মন্দির থেকে উঁচু-নিচু সবুজ উপত্যকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমির রাস্তা পেরিয়ে, ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ-এ পৌঁছালাম। বহু রকমের গাছে সাজানো বিশাল মনোরম বাগান। বাতাসিয়া লুপের কেন্দ্রে একটি যুদ্ধ স্মৃতিস্মারক আছে। চারপাশে পরিপাটি করে লাগানো রং-বেরঙের ফুল। এ যেন নান্দনিক এক প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমতা মিশ্রিত স্থাপত্য যা চমৎকার আর রোমাঞ্চকর অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে মনে। দার্জিলিং শহর থেকে পাহাড়ের উঁচু-নিচু পথের ট্রেনের যাত্রা সাবলীল করতেই বাতাসিয়া লুপ গড়ে তোলা হয়েছে। দার্জিলিং শহর থেকে মোট ষোল কিলোমিটার রাস্তা বাতাসিয়া লুপ হয়ে ট্রেনে চড়েই ঘুরে দেখা যায় পুরো দার্জিলিং শহর। দার্জিলিং শহরের ঘুম রেলস্টেশনকে বলা হয়ে থাকে ভারতের সবচেয়ে উঁচু আর পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ উঁচু রেলস্টেশন। স্টেশনটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত।
চলবে…