দ্বিতীয় পর্ব
রাজা ব্যানার্জি | ছবি: ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলি ও রুদ্ররাজ দাষ
সব্জি আর নুডলস দিয়ে থুকপা গোছের একটা খাবার বানিয়ে ব্রেকফাস্ট সার্ভ করলেন হোম স্টে-র মালকিন। এবার পথচলা শুরু। আমাদের মধ্যে একমাত্র সুময়-ই আসার আগে একটা ট্রেকিং স্টিক কিনেছিল। তা দেখে আমরা বাকিরা তো হেসে লুটোপুটি। মজা করে ওকে বললাম, তুই কি মহাপ্রস্থানের পথে চললি নাকি ! কিন্তু ট্রেকিং-এর শুরুতেই যখন গাইড বললো, ট্রেকিং স্টিক এর কথা, আমাদের মুখগুলো যেন কাঁচুমাচু হয়ে গেল। সে তো আমাদের কাছে নেই। উপায় বাতলে দিলো গাইডই। সবার জন্যই জোগাড় হলো প্রায় ছয় ফুট লম্বা বেতের শক্তপোক্ত একখানা করে লাঠি। পথে ওটাই ট্রেকিং স্টিক হিসেবে কাজে আসবে।
মনে অফুরন্ত উৎসাহ আর অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার এক আগ্রহ। ট্রেকিং স্টিক হাতে সুময় গাইতে গাইতে চললো, দুর্গম গিরি কান্তার মরু…। কয়েক কলি গাওয়ার পরেই গাইড বলে উঠলো, কে চিৎকার করছে ? চিৎকার করা যাবেনা। পথ ভালো নয়। বন্য জন্তু আছে। আর এনার্জি ও কমে যাবে চিৎকার করলে। থামলো গান। আধঘন্টা পেরিয়েছে কি পেরোয়নি, ক্লান্ত হয়ে বুকে হাত দিয়ে প্রথম বসে পড়লো সুময়-ই।
পাইনের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। বুঝলাম সবারই হাঁফ ধরছে। বিড়ি-সিগারেট খাওয়া কলজে। কত আর সহ্য হয় ! পৌনে এক ঘন্টা পর পৌঁছলাম এক সবুজ প্রান্তরের ধারে। বাঁদিকে খাড়া উঠে গিয়েছে এক পাহাড়। সেটা এতটাই উঁচু যে পিছন দিকে মাথা প্রায় নব্বই ডিগ্রিতে হেলিয়ে দেখতে হয় তার চূড়া। দেখলাম, সেই চূড়ায় ছোট্ট কি যেন একটা কাঠামো দেখা যাচ্ছে। আমি আর রুদ্র গাইড থাপার কাছে জানতে চাইলাম, ওটা কি কোনো মন্দির?গাইড বললো, ও হি তো টোংলু হ্যায়, সাব। কথাটা শুনেই কেমন যেন দমে গেলাম। কারণ আজ বিকেলের আগে ওখানে পৌঁছতেই হবে আমাদের। সেখানেই রাত্রিবাসের আয়োজন। মাঝে আর কিচ্ছু নেই। আমি শুধু বললাম, অতটা যেতে হবে আজই ! গাইড বললো, অনেক ট্রেকারই ধোতরে থেকে টোংলু হয়ে টামলিং পর্যন্ত চলে যায় একইদিনে। সন্ধ্যার আগে সেখানে পৌঁছয়। কিন্তু আমরা যেভাবে চলছি তাতে সন্ধ্যা ছটা কেন, রাত নটার আগে সেখানে যেতে পারবো না। আর পাহাড়ি রাস্তায় সেটা যাওয়া সম্ভবও নয়।
গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম আমরা সবাই। এবার পাহাড়ি পথটা যেন ক্রমশ সরু হয়ে এলো। এছাড়া পথটা বিপজ্জনক নয় আদৌ। রাস্তায় পড়ে রয়েছে রোডোডেনড্রনের গোল গোল শুকনো ফল। জঙ্গলের পথে চড়াই উৎরাই পেরিয়ে চললাম আমরা।
জল তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গাইডের স্পষ্ট নির্দেশ, যতই তেষ্টা থাকুক, ঢকঢক করে জল খাওয়া যাবে না। তাহলে হাঁটতে পারবেন না। বড়জোর এক ঢোক জলে গলাটা ভেজাতে পারেন। আর দরকারে সঙ্গে থাকা খেজুর, চকোলেট, চিউইংগাম খাওয়া যেতে পারে। সে পরামর্শ মেনেই চলে বিকেলের আগেই পৌঁছনো গেল টোংলু।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সান্দাকফুর উচ্চতা ১২ হাজার ফুট। আর মানেভঞ্জন প্রায় ৬ হাজার ফুট। মানে আজ সকালে যে ধোতরে থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম, তার উচ্চতাই দার্জিলিং, সিমলা বা মানালির সমান। গ্যাংটকের উচ্চতা আরো কম।
টোংলু একটি পাহাড়ের চূড়া। তার নামেই পাহাড়ি ছোট ওই জনপদের নাম। ভারত – নেপাল সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত টোংলু সিঙ্গালীলা জাতীয় উদ্যানের অংশ।উচ্চতা প্রায় ১০ হাজার ফুট। তার মানে প্রথম দিনের ট্রেকিংয়েই আমরা উঠে এলাম প্রায় ৪ হাজার ফুট। এটা ভেবেই মনে একটা জোর এলো। কিন্তু শরীর তখন ক্লান্ত, অবসন্ন।
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। জাঁকিয়ে পড়েছে ঠান্ডা। তারপরেও ট্রেকিংয়ের সময় এত গরম লাগে যে মনে হয়, গায়ের থেকে সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলি। কিন্তু খানিক বিশ্রাম নিতে বসলেই যেন চেপে বসতে শুরু করে ঠান্ডাটা। সূর্য ডোবার পর হাওয়ায় তো মনে হয় যেন হাড় ফুটো হয়ে যাবার উপক্রম।
এ সময়টা অফ সিজন। তাই আগে থেকে কোথাও বুকিং না করেই এসেছি আমরা। অসুবিধাও বিশেষ হয়নি।টোংলুতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা গাইড আগে থেকেই করে রেখেছিল। সেখানেই গিয়ে উঠলাম আমরা। দেখলাম সাকুল্যে ২০-২৫ ঘর মানুষের বাস সেখানে। তখন অবশ্য অর্ধেক ঘরই বন্ধ। এলাকায় রয়েছে সিনকোনা বাগান। সেটাও এলাকাটির একটি বৈশিষ্ট।
সিজনে নানা ধরণের সব্জি, মুরগির মাংস-সবেরই ব্যবস্থা করে দেন স্থানীয় মানুষেরা। অফ সিজনের পরিস্থিতি অন্য রকম। তবে প্রতি ঘরেই থাকে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, ডিম আর নুডলস। ব্রেকফাস্টই হোক কিংবা লাঞ্চ বা ডিনার, সারতে হবে তা দিয়েই। খিচুড়ি-অমলেট হোক কিংবা ভাত ডাল আলুভাজা ডিমের ডালনা, সেটা আপনার মর্জি। শীতের সন্ধ্যায় সঙ্গে থাকা রামে খানিক গলা ভিজিয়ে নিজেদের মধ্যে চললো আড্ডা। রাতে ভাত-কোয়াশের সব্জি আর ডিমের ডালনা সহযোগে ডিনার সারতে হলো তাড়াতাড়িই।
পরদিন সকাল থেকে যে আরো এগোনোর পালা।
চলবে…