বিজয়ীরাই ইতিহাস রচনা করে, যেমন করেছিল গ্রিক, রোমান কিংবা মিশরীয়রা। কিন্তু প্রাচীন যুগে শুধু তারাই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অন্যান্য সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠা সাম্রাজ্যগুলিও মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে অনেক দূর। এদের মধ্যে অনেকেই গড়ে তুলেছে আশ্চর্য সব শহর, নিজেদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতির সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সুফল কুড়িয়েছে। কিন্তু এই সব সাম্রাজ্যের তরফে দুর্ভাগ্যবশত বলা যায় যে এদের অনেককেই শত্রুকে গুড়িয়ে দেওয়া রোমান লিজিয়ন কিংবা গ্রিক হোপলাইট বাহিনীর সামনে পড়তে হয়েছে, আবার অনেককেই মুখোমুখি হতে হয়েছে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের। আবার অনেক সভ্যতার পতনের মধ্যে রয়ে গিয়েছে রহস্য। তবে একথা ঠিক যে এই সব সভ্যতা একদিন যেভাবে উদিত হয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই অস্তমিত হয়েছে। আর এই সব কারণেই তাদেরকে হারিয়ে যেতে হয়েছে ইতিহাসের পাতায়।
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস আর থাইল্যান্ডের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা খেমার সাম্রাজ্য বা সভ্যতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় সভ্যতাগুলোর একটি। জল ঘিরেই গড়ে ওঠা এবং জলকে কাজে লাগিয়েই সবচেয়ে দ্রুত নিজেদের সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়েছে ৮০০ থেকে ১৪০০ সাল পর্যন্ত উন্নতির শিখরে থাকা এই খেমার সাম্রাজ্য। মেকং নদীর কোল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা রাজধানী অ্যাংকরকে বলা যায় প্রাচীন পৃথিবীর অন্যতম বিশাল শহর, যা দখল করে রেখেছিল ১,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জায়গা আর আশ্রয় দিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ মানুষকে। শহরের অসাধারণ জল সরবরাহ ব্যবস্থার সাহায্যে মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হয়ে গিয়েছিল। জলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা সেই শহরের জলের ব্যবস্থা ছিল স্বয়ংক্রিয়, যে কারণে ইতিহাসবিদরা একে উপাধি দিয়েছেন হাইড্রলিক শহর।
শক্তিশালী অর্থনীতির জোরে খেমার সাম্রাজ্য কম্বোডিয়া ছাড়িয়ে প্রবেশ করে লাওস, থাইল্যান্ড আর ভিয়েতনামে, সংস্পর্শে আসে পশ্চিমের সুতখোনিয়া সাম্রাজ্য আর পূর্বে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী শ্যামের। খেমারদের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা দ্বিতীয় জয়বর্মন শ্যামদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করলেন, দখল করে নিলেন বেশ বড় এলাকা। বিশাল বড় সাম্রাজ্যকে ভাগ করা হলো ২০টি প্রদেশে, চীনের সাথে বাণিজ্য-ব্যবসা তুঙ্গে উঠলো। কাঠ, আইভরি, মশলা, মোম, সোনা, রূপা আর সিল্ক রপ্তানির অর্থের ভারে অ্যাংকর ডুবে যেতে থাকলো। তবে এই অবস্থা বেশিদিন চলতে পারেনি, কিছুদিনের মধ্যেই খেমারদের পতন ঘটল। কারণ তিনটি, প্রথমত, ক্রমবর্ধমান বৌদ্ধধর্মের সংস্পর্শে এসে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছিল। দ্বিতীয়ত, অ্যাংকরের জল সরবরাহ ব্যবস্থাও ক্রমশ কমে আসছিল। আর শেষটি হলো, তাদের ক্রমেই বেড়ে চলা বিশাল সাম্রাজ্য সহজেই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়েছিল।
খেমার রাজত্ব ৮০৫-১৪২৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দাপটের সঙ্গে টিকে ছিল। ২৫ জন রাজা এই সময়ে রাজত্ব করেন। তাঁরা এক হাজারের বেশি মন্দির নির্মাণ করেন, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আংকর ভাট। একাদশ শতাব্দীতে খেমার সাম্রাজ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী সাম্রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হয়। সাম্রাজ্যের সীমানা- পূর্বে চম্পা (মধ্যে ভিয়েতনাম), উত্তরে চীন, দক্ষিণে সাগর ও পূর্বে ব্রহ্মদেশ। দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় আংকর ভাট। শুরুতে আংকর ভাটের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজার। রাজা জয়বর্মণ ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ার মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত টনলে সেপ হ্রদের উত্তরে হরিহরালয়ে প্রথম রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে যশবর্মণ রাজধানী স্থানান্তর করেন যশোধারাপুরে। এটি বর্তমানে আংকর ওয়াট নামে পরিচিত।
কম্বোডিয়ার আঙ্কর ওয়াট মন্দিরই বিশ্বের সবচেয়ে বড় মন্দির হিসেবে স্বীকৃত। দ্বাদশ শতকের শুরুতে হিন্দু মন্দির হিসেবে এটি প্রতিষ্ঠা করা হলেও পরে তা বৌদ্ধ মন্দিরে পরিবর্তিত হয়। খেমার স্থাপত্যের অনুপম নিদর্শন এই মন্দিরসহ এখানকার পুরো মন্দির নগরটিই জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। প্রায় হাজার বছরের পুরোনো খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী নগরের সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্দির আঙ্কর ওয়াট মন্দির নগরই কম্বোডিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। বনাঞ্চল ও জলাধারসহ প্রায় ৪০০ বর্গকিলোমিটারের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই নগর। ৯ম থেকে ১৫ শতক পর্যন্ত খেমার সাম্রাজ্যের রাজধানী এবং প্রধান ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল এই এলাকা। কয়েক শতক ধরে একের পর খেমার সম্রাটরা ওই এলাকাতেই নতুন নতুন রাজধানী প্রকল্প ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। খেমারদের রাজধানীর বৈশিষ্ট্যই ছিল একেবারে নগরকেন্দ্রে প্রধান মন্দিরকে ঘিরে নগরের বিস্তৃতি। এখানকার মন্দির এবং অন্যান্য পুরাকীর্তির অনন্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্যসমূহ ভারতীয় ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় রীতির মিশেলে অনন্য কম্বোডীয় শিল্পসৌকর্য তৈরি করেছে।
৯ম শতকের শুরুতে সম্রাট দ্বিতীয় জয়বর্মণ সেখানকার দুটি রাজ্যকে একত্র করে খেমার সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। আজকের আধুনিক কম্বোডিয়ার ঐতিহাসিক ভিত্তি সেটাই। সম্রাট দ্বিতীয় জয়বর্মণের পুত্র যশবর্মণ এই এলাকার প্রধান হ্রদের কাছে যশধাপুর নামে যে নগর প্রতিষ্ঠা করেন সেটাই পরবর্তীতে আঙ্কর ভাট নাম ধারণ করে। ১১১৩ সালে দ্বিতীয় সূর্যবর্মণ খেমার সম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হন। তিনিই খেমার স্থাপত্যের চূড়ান্ত উৎকর্ষে আঙ্কর ভাট মন্দির ও রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় ভাষায় ‘আঙ্কর’ অর্থ নগর আর ‘ওয়াট’ শব্দটির অর্থ চত্বর বা সংলগ্ন এলাকা। সংস্কৃত ‘নগর ভাটা’ থেকে এই ‘আঙ্কর ভাট’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।