(প্রথম পর্ব)
অমিতাভ ত্রিবেদী
শীতকাল,বড়দিন, বাচ্চাদের স্কুল ছুটি, বন্ধুদের গ্রুপ, -অফিস ছুটি, উৎসবের আমেজ, জঙ্গল- এই শব্দগুলির মেলবন্ধন হলে একটি কথাই মাথায় আসে ‘ভ্রমণ’। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা, লক ডাউন, সামাজিক দূরত্ব- সাস্হ্যবিধি পালন, গৃহবন্দী দশা, মৃত্যু- এই শব্দগুলি এখন আমাদের মাথায় ঘাঁটি গেড়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে কবে ফিরবো জানিনা। অথচ একসময় কর্মজীবনের ব্যস্ততা, ক্লান্তি আর একঘেয়ে জীবন থেকে একটু খোলা বাতাস বা বিশুদ্ধ অক্সিজেনের চাহিদায় আমাদের কর্মস্থল, বাচ্চাদের পড়াশুনা ও গৃহিনীদের ঘর-সংসার বা নিদেনপক্ষে রান্নাঘর থেকে কিছু দিনের ছুটি বা বিরতি নিয়ে পাহাড়, সমুদ্র বা জঙ্গলে যাওয়া শরীর ও মনের পক্ষে একরকম জরুরি ছিল। অতীতে প্রতি বছরই এমন কয়েকবার কমপক্ষে একবারও কোথাও না কোথাও ভ্রমণ করেছি, সে পরিবার বা আত্মীয় পরিজন বা বন্ধুগোষ্ঠী দলবদ্ধভাবে ।
আজ খুব মনে পড়ছে এমনই এক ভ্রমণের কথা। আমরা আট বন্ধু মানে বাল্যবন্ধু পরিবার সহ বেশ কয়েক বছরের স্বপ্নের সফল রূপান্তর করতে পেরেছিলাম। শীতকালে বছরান্তে ক্রীসমাসের ছূটিতে গিয়েছিলাম ডুয়ার্সের জঙ্গলে। মনে পড়ছে দিনগুলোর স্মৃতি যা এখনও বিস্মৃত হয়নি। প্রথমত দিন সাতেক একত্রে বন্ধুদের সাথে থাকবার আনন্দ, প্রানখোলা হাসি-ঠাট্টা, মজা, খুনসুটি, বদমাইশি- যার সবকিছুই ছোটো বেলায় তথা ব্যাচেলর জীবনেই ফেলে এসেছিলাম। তা আরও একবার ফিরে পাওয়ার আকুতি সার্থক হতে চলেছে ভেবেই রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম। দিন গুনতে থাকলাম। আমার মতোই সবারই অবস্থা। কত জল্পনা- কল্পনা -পরিকল্পনা- আলোচনা- দায়িত্ব ভাগ।রেলওয়ে টিকিট বুকিং-হোটেল বুকিং-দিনপঞ্জি- পরিবার পিছু বাজেট সব সুষ্ঠু ভাবে সমাধা করে নির্দিষ্ট দিনটির অপেক্ষা। দলটিও বেশ বড়, আমরা আট বন্ধু, প্রত্যেকের স্ত্রী এবং সকলের একটি সন্তান শুধুমাত্র আমার দুটি সন্তান। অর্থাৎ ৮+৮+৯ মোট ২৫ জনের দল। আমাদের জুনিয়রদের বয়স তখন ৪ থেকে ৮ এর মধ্যে। এখানেও ভারসাম্য ছিল, চার পুত্র ও পাঁচ কন্যা। সবাই সবার পূর্ব পরিচিত অর্থাৎ তাদের লাগাম ছাড়া আনন্দ। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত দিন এসে গেল। ২৪ শে ডিসেম্বর ব্যাগপত্তর খাবার দাবার গুছিয়ে সন্ধ্যা বেলায় ট্রেনে উঠে পড়লাম। আমাদের গন্তব্য আলিপুরদুয়ার জংশন।
পরদিন বড়দিন। সকাল হতেই জুনিয়ররা ঘুম চোখে আবিষ্কার করল সান্তা ক্লজের উপহার। কিন্ডার জয়, বেলুন, ক্যাডবেরি, টুপি আরও কত কি। ট্রেনের মধ্যেই ব্রেকফাস্ট কেক অপরিহার্য। নির্দিষ্ট সময়েই পৌঁছালাম। স্টেশনে অপেক্ষা করছিল ২৪ সিটের ছোটো বাস। যেটা আমাদের বুকিং করা ছিল ভ্রমণের শেষ দিন পর্যন্ত। আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থল বক্সা ও জয়ন্তী। বাস যাত্রা শুরু। একসঙ্গে ২৫ জন যাত্রা করার ফলে সময়টা যেন নিমেষে কেটে গেল। হাসি- ঠাট্টা-গান-বাজনা-নাচ- অন্তাক্ষরী কোনোটাই বাদ নেই। আর আমাদের সঙ্গে ছিল আহুজার পোর্টেবল সাউন্ড সিস্টেম, পুরো ভ্রমণে যা ছিল অপরিহার্য। অতঃপর রাজাভাতখাওয়া পেরিয়ে বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করল বন দপ্তরের স্বীকৃতি নিয়ে। তারপর প্রায় সাত কিমি গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পৌঁছালাম জয়ন্তী নদীর তীরবর্তী পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা একটি ছোট গ্রামে। বুকিং আগেই করা ছিল হোটেলে। জয়ন্তী নদী শুকনো। পাহাড়ে বৃষ্টি হলে তা জলে ছাপিয়ে যায়। অদুরে পাহাড়। পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার আলোয় নদীর সাদা নুড়ি পাথরে পড়ে এক অসাধারণ মায়াবী পরিবেশ।
২৫ ডিসেম্বরের রাত, হোটেল ও আমাদের ঘরগুলোকে সাজালাম । Candle light, Music- Mary Christmas, Cake, chocolate, dance – হৈ হুল্লোড় সাথে Fun games, কুইজ – উত্তর দিলেই আকর্ষণীয় পুরস্কার। ছোট বড় সবাই অংশ নিল। কখন যে রাত গভীর হলো কেউ খেয়াল করতে পারল না। এই ভাবেই রাতটা স্মরণীয় হয়ে উঠল। পরের দিন পরিকল্পনা মাফিক বক্সা ফোর্ট অভিযান। সে যেন ‘ পাহাড়ের গায়ে জেলখানা’। ব্রেকফাস্ট সেরে গাড়ি করে জিরো পয়েন্টে এলাম। সেখান থেকে পায়ে হাঁটা, চড়াই উতরাই রাস্তা ধরে যেতে হবে বক্সা দুর্গ। তবে কঠিন নয়। যাত্রাপথে মনোরম পরিবেশ, মাঝেমধ্যেই ছোট বড় সাঁকো, নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলের ধারা। মাঝেমধ্যে জয়েকটি ছোট ছোট জনবসতিও চোখে পড়ল। বাড়ি সংলগ্ন খাদ্য সামগ্রীর দোকান পথিকদের কথা ভেবে। আমরাও যাওয়া আসার পথে আমাদের চাহিদা মতন স্বাদ গ্রহণ করলাম – চা বিস্কুট, মোমো নুডলস, যা আমাদের তথা জুনিয়রদের তরতাজা করে তুলেছিল। আড়াই-তিন কিলোমিটার রাস্তা পথ শেষে পৌঁছলাম ঐতিহাসিক বক্সা ফোর্ট। অযত্নে লালিত, দুর্গের গায়ে গজিয়েছে গাছ। চাতালে শেওলা পড়েছে। ভেঙে পড়ছে অনেক অংশই। তবুও কাঠামোটি দেখে মোটের ওপর তার অতীত রূপটি বুঝতে অসুবিধা হয়না এখনো। দুর্গের ইতিহাসও বেশ পুরানো। অবস্থান গত গুরুত্বের জন্য ব্রিটিশরা ১৮৬৫ সালে ভুটানের রাজার কাছ থেকে এই দুর্গ দখল করে এবং কারাগার তৈরি করে। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দী করে রাখা হতো সেখানে।
১৯৩৯ সালে বন্দী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চিঠি লেখেন। তিনি তখন ছিলেন দার্জিলিং এ। প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ একটি চিঠি লেখেন যার প্রতিলিপিও এখানকার দ্রষ্টব্য। বক্সা ফোর্টের ধ্বংস প্রায় ঘরগুলোর মধ্যে ঢুকে এক আশ্চর্য অনুভূতি হচ্ছিল। কাছেই রয়েছে একটি সংগ্রহশালা। আমাদের জুনিয়ররা দুর্গের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝতে না পারলেও লুকোচুরি খেলে মজা পেলো। ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে এখানকার প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্য ক্যামেরা বন্দী করে জিরো পয়েন্টে ফিরে এলাম। তারপর সেই রাতটা জয়ন্তীতে কাটিয়ে পরবর্তী দিন অন্য গন্তব্যে যাত্রা।
পরদিন সকাল সকাল ব্যাগপত্তর বাসে তুলে যাত্রা শুরু পরবর্তী গন্তব্যে। পথিমধ্যে ঝটিকা সফরে ভুটানের গুম্ফা মন্দির। ফুন্টসেলিং হয়ে পাহাড়ের ওপর মন্দির দর্শন। আমাদের জুনিয়রদের বিশ্বাসই হচ্ছিলো না পাসপোর্ট ছাড়া বিদেশ ভ্রমণ। আধার কার্ডই যথেষ্ট। গুম্ফা মন্দিরের শুদ্ধতা, পরিচ্ছন্নতা, শান্তি ও শিল্প কলা মনকে স্নিগ্ধ করে তুলল। শহরটিও বেশ পরিচ্ছন্ন।পাহাড়ের ওপর থেকে ভারত দর্শন এক অসাধারণ অনুভূতি। ফেরার পথে অল্প সময়ের জন্য কুমিরের চিড়িয়াখানা দেখে অবাক হলাম। ছোটরা উপভোগ করল বেশ। পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে রওনা দিলাম জলদাপাড়া অভয়ারণ্য সংলগ্ন মাদারিহাটে। গন্তব্য স্থানে পৌঁছে নিজেরাই সেই রাত ও পরের দিনের জন্য রান্না বান্নার জন্য বাজারহাটের ব্যবস্থা করলাম ঠাকুরের সহায়তায়। ঠাকুরের হাতযশে বেশ সুস্বাদু আহারই মিললো।
ওই রাতে গান বাজনা, অন্তাক্ষরী, বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড়, চিল চিৎকারে হোটেল সরগরম করে তুলেছিল। আশ্চর্য হতে হলো কচি কাঁচাদের অফুরন্ত উৎসাহ দেখে। দলবদ্ধভাবে খাওয়া, স্নান করা, খেলাধুলা। ক্লান্তিহীন , কখনো বন্ধুদের চক্ষু হারা না করা। পরের দিনের পরিকল্পনা জলদাপাড়া ফরেস্টে জিপ সাফারি।
(চলবে)