পঞ্চম পর্ব
রাত বেশ খানিকটা, প্রায় ১০টা বাজতে চলল। তখনও সুর খেলছে নিখিলবাবুর উঠোনে। দেখলাম ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে তাঁর ‘গুরুশিষ্য সুহৃদ মিলন মেলা’র অনুষ্ঠানের। কয়েকজন কাজ করে চলেছেন। সবই অপরিচিত মুখ। সবাই কিন্তু কাজ ফেলে স্বাগত জানালেন। বুঝলাম নিখিলবাবু আমাদের আসার কথা আগেই জানিয়ে রেখেছেন। জুতো খুলে প্রথমেই ঢুকলাম তাঁর ‘সাধন গৃহে’। সত্যিই এ ঘরকে সাধন গৃহ ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। হারমনিয়ামে নিখিলবাবু নিজে, আর অন্যেরা? কয়েকজনের হাতে দোতারা, কেউ কেউ বাজাচ্ছেন বাঁশি। খোল, কর্তাল, খমক আর ঘুঙুরের বোলে একেবারে জমজমাট। সমবেত গানে সবাই প্রায় আত্মহারা। নিতান্ত কালাপাহাড়ের মতো নিজের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে আমিই সবার তাল ভঙ্গ করলাম। নিখিল বাবু আন্তরিক ভাবে ডেকে তাঁর পাশে বসিয়ে শুরু করলেন শাহ আব্দুল করিমের কালজয়ী গান, “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম… “। চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখি ডম্বরু, শিঙা থেকে আরম্ভ করে বাংলার এমন কোনো লোক বাদ্যযন্ত্র নেই যা এখানে অনুপস্থিত। এসব বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সাজানো এ ঘর কিন্তু কোনো সৌখিন ড্রইং রুমের শোভা নয়, সব যন্ত্রই সুরে বাজে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার সবই নিখিলবাবুর নিজের হাতে তৈরি আর সবই উনি বেশ দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারেন।
গানের আসর শেষ হলো, সবার সঙ্গে আলাপ পরিচয় হলো, অধিকাংশই ওনার ছাত্রছাত্রী, কেউ কেউ এসেছেন ২৫০, ৩০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি দূর থেকে। গান যাঁরা গাইছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ছাত্রছাত্রী বাদে পাড়ার অনেক বৌ’ঝিয়েরাও। ভাবা যায় আজকের এই স্বার্থপরতার যুগে, প্রায় হারিয়ে যাওয়া এই লোক গান ও বাদ্যের উৎসবকে উনি পরিণত করেছেন পাড়ার সবার উৎসবে। নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার, আসলে এক লোকায়ত মানুষ। মানুষটি চেহারায় একেবারে আর পাঁচ জনের মতোই কিন্তু কর্মে, চিন্তায় ও মননে ভীষণ অন্যরকম। এরকম সুর পাগল, গানের ঐতিহ্যবাহী মানুষ আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। তাঁর ‘মুরলী লোক সাংস্কৃতিক বিকাশ কেন্দ্রে’কে জানতেই এবার বাংলাদেশে আসা। এক কথায় না এলে এমন মানুষ যে আজও বর্তমান এমনটা জানার অভিজ্ঞতা হতো না। নিখিল কৃষ্ণ মজুমদার এমন একজন বিরলতম গুরু যিনি তাঁর সব কিছু উজাড় করে দিতে চান পরের প্রজন্মকে। এখানে শুধু গান বা বাদ্যযন্ত্র শেখানো হয় না, শেখানো হয় সেগুলো সহজে বানানোর পদ্ধতিও। এমন গুরু যদি থাকেন সাথে, হাজার চেষ্টাতেও উপড়ে ফেলা যাবেনা আমাদের লোকায়ত শিকড়। আমাদের এ বাংলায় সদানন্দ দাসের কথায়, সনাতন দাস বাবাজীর গলায় বহুবার শোন একটা গানের কথা মনে এল, “রাখিতে নারিলি প্রেম জল…/ও…কাঁচা হাঁড়িতে রাখিতে নারিলি প্রেম জল।/যদি হবি পাকা হাঁড়ি, তবে গুরুর বাড়ি চল”।
এখন অবশ্য অনেকেই লম্ফঝম্প করে গানের অনেক কিছুই বদলে দিয়েছে। সেসব নিয়ে কথা নয়। শুধু বলি পাকতে হলে সময় লাগে, আর লাগে গুরুর দেখানো পথ। এমন গুরু সহসা মেলেনা, আর পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিখিলবাবুর কথা এত সহজে, কয়েকটা অক্ষরে শেষ হওয়ার নয়। সে চেষ্টা করছিও না, আলাদা করে বিস্তারিত জানাবো যদি সময় ও সুযোগ ঘটে।
কয়েকজন ছাত্রকে ডেকে নির্দেশ দিলেন আমার থাকার ব্যবস্থা করতে। আমাকে বিড়ম্বনায় ফেলে আগেই মার্জনা চেয়ে নিলেন এই উৎসবের সময় অনেক লোকের ভিড়ে ঠিক ঠিক সময় এবং আতিথেয়তা দিতে পারবেন না বলে। অনেকের সঙ্গে আমার আশ্রয় হলো ওনার শিক্ষা নিকেতন ও আপাত অতিথি নিবাস ‘লালন-বিজয় স্মৃতি ভবনে’। সত্যিই তাক লেগে গেল। একেবারে আড়ম্বরহীন, অজস্র লোক বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সাজানো এই ভবনটি দেখে। একে ভবন না বলে সাধন গৃহ বলাই ভালো। আসলে ভবন শব্দটা আমার কাছে বেশ গুরুগম্ভীর, কেমন যেন খানিকটা দুরত্ব তৈরি করে। আর গৃহ? মনে হয় শান্ত স্নিগ্ধ, মায়ের কোলের মতো।
সকাল সকাল বেরিয়ে দেখি রাতের কুয়াশা আরও ঘন হয়ে চারিদিক ঢেকে ফেলেছে। তারই মাঝে বেরিয়ে পড়লাম। ঘন কুয়াশা আর ঘন সবুজ মিলে মিশে একাকার। যেন জলছবি। প্রকৃতির আঁকা এছবি কোনোদিনই কোনোও দক্ষ শিল্পীর হাতে ধরা দেবেনা। বহুকাল চোখে পড়েনি এমন নিবিড় ঘন গাছপালা। এমন কোনো বাড়ি দেখলাম না যা অজস্র গাছে ঘেরা নয়। হাজার হাজার সুপারি গাছ লম্বা হয়ে আকাশের দিকে উঠে গেছে, আরও কত নাম না জানা মহীরুহ। সবাই যেন সবাইকে পাল্লা দিয়ে আরও লম্বা হতে চায়। প্রতিটি বাড়ির সীমানায় গাছের প্রাচীর। একটা গাছকেও এরা অপ্রয়োজনীয় মনে করে না, সবাই কে বাঁচিয়ে রেখেছে সযত্নে, গভীর ভালোবাসায়। আমাদের ঘরবাড়ি আর আশপাশের কথা ভেবে নিজেদের কত দীন মনে হয়। আমাদের এখানে এমনও দেখেছি, উঠোনে পাতা পড়বে বা হুনমান এসে বসবে কিংবা ঝড়ে গাছ পড়ে বাড়ির ক্ষতি করবে এমন আশঙ্কায় আগেভাগেই গাছ কেটে ফেলা হয়। আর যারা প্রায় সারা বছর ঝড়জল নিয়ে বসত করে তারা নিজের থেকে একটাও গাছ অপ্রয়োজনে কাটে না।
পাড়া ছাড়িয়ে মাঠের দিকে গিয়ে দেখি শয়ে শয়ে খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধা। এমন গাছও চোখে পড়লো মাটিতে দাঁড়িয়েই যার রস নামিয়ে নেওয়া যায়, এমনকি সোজা হয়ে দাঁড়ানোর দরকারও নেই। এমন ছোট গাছে এভাবে রস নামাতে এর আগে দেখিনি। আরও একটা দারুণ ব্যাপার দেখলাম এখানে, আমাকে অপরিচিত দেখে অনেকেই অবাক হচ্ছেন ঠিকই কিন্তু সবাই প্রাথমিকভাবে আমার কুশল জিজ্ঞেস করছেন। আমি ও বাংলা থেকে এসেছি জেনে তাঁরা যেন আরও খুশি। এরা অবশ্য সবাই ও বাংলা বা কলকাতা না বলে ইন্ডিয়া বলতে ভালোবাসেন। যিনি খেজুর গাছে রসের হাঁড়ি বেঁধেছেন সেই প্রবীণ মানুষটির সঙ্গেও দেখা হলো, তিনিও একগাল হেসে আমার কুশল জিজ্ঞেস করলেন। ওঁর কাছে জেনে নিলাম এমন ছোট গাছের রস কতটা সুমিষ্ট বা গাছের জন্য ক্ষতিকর কিনা? দার্শনিকের মতো উনি জানালেন, ‘ এমন অকৃপণ বৃষ্টিপাত আর উর্বর প্রকৃতির কাছে কোনো কিছুই ক্ষতিকর নয়’। আমি ইন্ডিয়া থেকে এসেছি জেনে, খুব খুশি হয়ে আমন্ত্রণ জানালেন টাটকা রস খাওয়ার জন্য। কিন্তু আমাদের নাগরিক বদঅভ্যাস আমাকে চায়ের দিকেই টেনে নিয়ে গেল। তখনও সবার ঘুম ভাঙেনি সুতরাং বন্ধ চায়ের দোকান দেখলাম, শুধু চায়ের মুখদর্শন হলো না।
আজ বাদে কাল এঁদের বার্ষিক উৎসব, তবুও অনেকেই এসে পড়েছেন। অবশ্য আমি বাদে আর প্রায় সবাই নিখিল বাবুর ছাত্র। তাঁদের মধ্যে যেমন ঝকঝকে তরুণ রয়েছে তেমনি রয়েছেন কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়া কেউ কেউ। মাঝের লকডাউনের সময় নিখিল বাবু তাঁর শিক্ষা দিয়েছেন অন লাইনের মাধ্যমে। তাই নিখিল বাবুর ছাত্রছাত্রী ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের বহু জায়গায়। যেমন আমার সফর সঙ্গী দুলাল ও বাঙলা অর্থাৎ ইন্ডিয়ায় থেকে একসময় তার দোতারার শিক্ষা আরম্ভ করেছিল অনলাইনের মাধ্যমে। নিখিল বাবু একক মানুষ। নিজে জীবনযাপন করেন সাধকের মতো, নিজের বাসস্থানটিও গড়ে তুলেছেন আশ্রমের আদলে। সবাই তাঁর ছাত্রছাত্রী হলেও অতিথি তো বটেই তাই অতিথি সেবায় হাত লাগিয়েছেন পাড়ার অনেকেই। সকালের জলখাবার হিসাবে খেলাম অদ্ভুত সুন্দর, নানান সবজি মেশানো এক পাতলা খিচুড়ি। আমাকে আবার বিশেষ খাতির করে বিড়ম্বনায় ফেলতে শুরু করলো পাড়ার এক তরুণী। পরে জানলাম তরুণী এ পাড়ারই মেয়ে, এখন বিবাহ সূত্রে থাকে খুলনা শহরে। সম্পর্কে নিখিল বাবুর ভাইঝি। খুলনা থেকে আগেভাগেই স্বামী সন্তান নিয়ে এসে পড়েছে অতিথি সেবায় হাত লাগাতে।
চলবে…