বন বা জঙ্গলের কথা বললে চোখের সামনে ভেসে ওঠে শত শত গাছের সারি। অসংখ্য গাছে কোনো সমতল ভূমি পরিপূর্ণ হলে তাকে আমরা বন বা জঙ্গল বলে চিনি। বন মানেই হলো বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গাছ গাছালিতে মোড়া এক সবুজ আবহ। কিন্তু যদি আপনাকে বলা হয় পাথরের বনের কথা? অবাক হচ্ছেন তো? ভাবছেন পাথরের আবার বন হয় কী করে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যিই এমন বন রয়েছে এই পৃথিবীর বুকে। অন্যরকম এই পাথরের বন দেখতে আপনাকে যেতে হবে চীনে। যেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত পাথর। পুরো এলাকা পরিচিত ‘স্টোন ফরেস্ট’ অর্থাৎ পাথরের বন নামে। চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে প্রায় ৮৫ কিলোমিটার দূরে অদ্ভুত এ বনের অবস্থান। স্টোন ফরেস্টের আয়তন সাড়ে তিনশো বর্গকিলোমিটার।

দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিস্তৃত ঘন জঙ্গল। শুধু পার্থক্য একটাই। রহস্যময় এই জঙ্গলের রং কালো। কালো হওয়ার কারণ এই জঙ্গলের গাছগুলো সব পাথর! ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট বড় অগণিত প্রস্তর-বৃক্ষ। আগে এই অঞ্চলের নাম ছিল শাইলিন। শাইলিন শব্দের অর্থই হল পাথরের জঙ্গল। গুহার মধ্যে যেমন স্ট্যালাগমাইট গড়ে ওঠে, এই প্রস্তর অরণ্য অনেকটা তেমনই দেখতে। গাছের মতোই মাটি ভেদ করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি পাথর। পুরো অরণ্যটাই চুনাপাথরের। তাই এই জঙ্গলে প্রবেশ করলে তাজা অক্সিজেনের পরিবর্তে চুনাপাথরের গন্ধ নাকে আসবে। এই অরণ্য ৭টি অঞ্চলে বিভক্ত। জলপ্রপাত, দুটো বিশাল হ্রদ, প্রাকৃতিক গুহা এবং এই পাথরের জঙ্গল সব মিলিয়ে পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। ২০০৭ সালে এই এলাকার দুটো অংশ নাইগু প্রস্তর অরণ্য এবং সুওগেয়ি গ্রাম ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে ঘোষিত হয়। বিস্ময়কর এই ভূমিরূপ ২৭ কোটি বছরেরও বেশি প্রাচীন। চীনের কুনমিং থেকে বাসে এখানে আসা যায়। প্রতি বছর দেশ বিদেশ থেকে প্রচুর পর্যটক এসে ভিড় জমান। ফলে অনেক হোটেলও গড়ে উঠেছে।

পাথরের অরণ্যের সৃষ্টি নিয়ে একাধিক মতবাদ রয়েছে। এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দাদের কাছে এক সুন্দরীর অপূর্ণ ভালবাসার সাক্ষী এই অরণ্য। অশিমা নামে ওই তরুণীর ভালবাসা নাকি পরিণতি পায়নি। তাকে অভিশাপ দিয়ে পাথর করে দেওয়া হয়েছিল। সেই দুঃখেই নাকি বাকি সব গাছ পাথর হয়ে যায়। তার সেই করুণ কাহিনির সাক্ষী এই পাথর-অরণ্য। তবে ভূবিজ্ঞানীদের মতে, এক সময় গভীর জলাশয় ছিল এখানে। জলাশয়ের নীচে নিমজ্জিত ছিল এই পাথরগুলো। ক্রমে জলের স্তর নামতে শুরু করলে জঙ্গলের মতো পাথরগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তার পর দীর্ঘ সময় ধরে বাতাসের সঙ্গে ঘর্ষণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এই রকম আকার ধারণ করেছে। প্রতি বছর ষষ্ঠ চন্দ্রমাসের ২৪ তারিখে এই এলাকার বাসিন্দারা এক বিশেষ উৎসব পালন করেন। তাদের লোকনৃত্য এবং কুস্তি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ। চীন ছাড়াও তুরস্কে পাথরের এমন বিস্ময়কর জঙ্গল দেখতে পাওয়া যায়। তুরস্কের কাপাডোশিয়ায় ওই পাথরের ভিতরে গুহা তৈরি করে এক সময় মানুষ বসবাস করতেন

এক দুই দিন নয়, এ বনের ইতিহাস বেশ পুরোনো। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, প্রায় ২৭০ মিলিয়র বছর সময়ে স্টোন ফরেস্ট আজকের এই অবস্থানে পৌঁছেছে। শত শত বছর ধরে সাগরের তলদেশে জমা হচ্ছিল লাইম স্টোন। এরপর, হয়তো কোনো এক সময় এই এলাকাতে বয়ে গেছিল বড়সড় কোনো ভূমিকম্প। কিংবা প্রকৃতির কোনো রহস্যময় কারণে এখানকার ভৌগলিক পরিবর্তন ঘটেছিল। যার ফলে সাগরের তলদেশের পানি শুকিয়ে যায় আর সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে লক্ষ বছরের পুরোনো সেই লাইম স্টোন। সারি সারি লাইম স্টোন মিলিয়ে সৃষ্টি স্টোন ফরেস্টের। আজও এখানকার পাথরের বুকে পাওয়া যায় নানা সামুদ্রিক ফসিলের ছোঁয়া।

প্রকৃতির এক অপার বিস্ময় এ বনটি। ইউনানের সাইলন জেলায় অবস্থিত বনটির চারপাশে পাথরের অভূতপূর্ব সব কারুকাজ। এটি হিমালয় পর্বতমালারই একটি অংশ। নানা আকৃতির, নানা উচ্চতার বিচিত্র সব পাথর এখানে এমনভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে যে মনে হবে এক গভীর জঙ্গল। ২০০৭ সালে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে পাথুরে এই বনটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের কেন্দ্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে।