দ্বিতীয় পর্ব
আমাদের ওখানের মতো অটো ও গাড়ির লোকজন এখানেও ছেঁকে ধরলো। বুঝলাম এর নাম অভাব। এরা অভাবকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচে তাই শিকার ধরতেই হয়। একদিনের শিকার হাতছাড়া মানে একদিন ভাতের অনিশ্চয়তা। সবাইকে বোঝালাম আগে ভাই পেট ঠান্ডা তারপর অন্য কিছু।
বেশ পরিচ্ছন্ন ভাতের হোটেল, মাছ, মাংস, ডিম সবই পাওয়া যায়, মাছের নানা কিসিম। অবশ্য নামগুলো আলাদা। যেমন কুড়চা মাছ যেটি আমাদের ভেটকি, সেটা জানলাম খাওয়ার পরে হোটেল মালিকের কাছে। তেলাপিয়া, ট্যাংরা, আড়, রুই আরও নানান ধরনের মাছ ছিল। শেষ পর্যন্ত পকেট মেপে চলতে হবে তাই ভাত আর রুই মাছ চেয়ে নিলাম। দাম কিন্তু একেবারেই বেশি নয়। ভাত কুড়ি টাকা আর সঙ্গে রুই মাছের ঝোল একশ টাকা। টেবিলে বসানো থাকে রসুন ফোড়নের ডাল, প্রয়োজন মতো নিতে বাধা নেই। মাছের ঝোলে দেখলাম দু’টুকরো আলু আর এক টুকরো পটল। সঙ্গে পেঁয়াজ, লেবু আর কাঁচালঙ্কা ফ্রি। এক্কেবারে তোফা বন্দোবস্ত। খুব তৃপ্তি করে খেলাম, রান্নার ধরণ একটু আলাদা কিন্তু স্বাদ অতুলনীয়। আসলে পেটে যখন আগুন জ্বলে, সবের স্বাদই অতুলনীয়।
বাংলাদেশ দেশ থেকে কারো সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা যাবে না যদি ইন্টারনেট থাকে তবে মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলা যায়। একটা এদেশি ফোন বুথ থেকে এখানকার একটা সিমে রিচার্জ করিয়ে নিলাম যদিও শেষ পর্যন্ত সেটা কাজ করেনি। প্রথমে ভেবেছিলাম আধুনিক কারিকুরি আমার অজানা তাই ইন্টারনেট আমাকে ধরা দেয়নি। পরে এ যুগের ফোনে দক্ষ কেউই ইন্টারনেট আনতে সফল হয়নি। অর্থাৎ অভিযানের শুরুই হলো ঠকে। আসলে ঠগ সব জায়গাতেই আছে, সঙ্গে আছে অজস্র ভালো মানুষ। সে উদাহরণ পেলাম প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই।
পেট্রোপোল পেরিয়ে বেনাপোল। বেনাপোল বর্ডার বাংলাদেশিদের ও ভারতীয় বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকেই দু’দেশের বানিজ্যিক লেনদেন হয় সবচেয়ে বেশি। আমরা আমজনতা যখন পদ্মার ইলিশের জন্য হাপিত্যেশ করে থাকতে থাকতে খবরের কাগজের পাতায় তার অনুসন্ধান চালাই তখন দেখি কয়েক হাজার টন পদ্মার রুপোলী ফসল নাকি আটকে রয়েছে বেনাপোলে। এই সীমান্ত বাঁধনে কার লাভ হয় জানি না। কিন্তু এটা জানি আমজনতার পাতে পদ্মার নাম নিয়ে অনেক ভেজাল ইলিশ শোভা বর্ধন করে। ছুঁচো গেলার মুখ করে, কেন পদ্মার ইলিশের এই হাল তা নিয়ে তখন আমরা বিতর্কে মাতি। মাঝখানে নেপোয় মেরে দিয়ে যায় দই।
যাই হোক বেনাপোলের চেহারা আর পাঁচটা ব্যাবসা কেন্দ্রের মতোই। রাস্তার দু’পাশে বড় বড় বিল্ডিং, সামনের ফুটপাত পর্যন্ত পশরা নেমে এসেছে। এক সাইডে ভারতে ঢোকার অপেক্ষায় সার সার বিশাল চেহারার হাজার ট্রাকের লাইন। কিন্তু একটাও সাইনবোর্ড কিংবা হোর্ডিং চোখে পড়লো না যেখানে বাংলা ছাড়া অন্য অক্ষর রয়েছে। আর যেটা অবাক করলো সুশৃঙ্খল ভাবে রাস্তার অপর পার দিয়ে চলছে স্থানীয় যানবাহন। কেউ কাউকে টপকে গিয়ে রাস্তা জ্যাম করছে বা চড়া গলায় প্রায় অশ্লীল কথায় গল্প করতে করতে, পানের পিক রাস্তায় ফেলে হিরো সাজছে এমটি চোখে পড়লো না। বেশ খানিকটা পথ পেরিয়ে ভ্যানরিক্সাওয়ালা আমাদের পোঁছে দিল বেনাপোল স্টেশনে। ভাড়া দিতে গিয়ে সত্যিই অবাক হলাম দু’জনের জন্য মাত্র ২০টাকা, তাও আবার বাংলাদেশি টাকায়। অর্থাৎ মাথাপিছু আমাদের ভারতীয় টাকায় বড়জোর সাত। আমি সত্যিই ভাবতে পারিনি আজকের দিনে এতটা পথ এত কম টাকায় আসা যায় বলে।
বেনাপোল রেল স্টেশন ভারত সীমান্তে বাংলাদেশের প্রথম বা শেষ স্টেশন। সারাদিনে এখান থেকে মাত্র দুটি ট্রেন খুলনা পর্যন্ত যাতায়াত করে। একটি সকল ৯টায় অপরটি বিকাল ৫টায়। সকালের ট্রেনটি ধরার প্রশ্ন ছিল না কারণ সেটাই খুলনা গিয়ে আমাদের নেওয়ার জন্য আবার ফিরে এসেছে। একেবারে সাবেকি রেলস্টেশন, আধুনিকতার ছোঁয়া খুব একটা পড়েনি। পুরানো সিনেমায় দেখা আমাদের পশ্চিমের স্টেশনগুলোর মতো। এখনো কাস্ট আয়রণের লম্বা বাতি স্তম্ভে ঢাকনা লাগানো আলো জ্বলে। লাইনের উপর কোনো ইলেট্রিক তার টাঙানো নেই। কল্পনা করছি হয়তো দেখবো ফোঁস ফোঁস করে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে সেই আগেকার রাজকীয় রেল ইঞ্জিন এসে দাঁড়াবে। মাথায় ফেট্টি বাঁধা ঘর্মাক্ত মুখে, ঠোঁটে বিড়ি চেপে বেলচা হাতে কেউ মুখ বাড়িয়ে দেখবে স্টেশনের যাত্রীদের।
না তেমনটা ঘটেনি। বহুকালের ডিএমইউ ট্রেন চলে এখানে। পুরানো দিনের নিচু চালের টিকিট কাউন্টার। টিকিটের সব কিছু লেখা বাংলা হরফে। শুধু একটিই ছন্দপতন, তারিখটি দেওয়া হয়েছে একটি রাবার স্ট্যাম্পে, তার অক্ষরটি ইংরেজিতে। ভাড়া বেশি নয়, ৯২ কিলোমিটার রাস্তা বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৪৫। এই ৯২ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে বেনাপোল আর খুলনার মাঝে নাভারণ, ঝিকরগাছা, যশোর, সিঙ্গীয়া, নওয়াপাড়া আর দৌলতপুর এই ৬টি জায়গায় মাত্র ট্রেন দাঁড়াবে।
প্লাটফর্মে হাজার হাজার কম্বল আর প্লাস্টিকের বালতি, মগ আর নানান তৈজসপত্র ডাঁই করা রয়েছে। সবই নাকি আমাদের সঙ্গে খুলনা যাবে। এসব জিনিসপত্রও নাকি সব এসেছে ভারত থেকে চোরা পথে। সীমান্ত রক্ষীদের চোখ এড়িয়ে এত জিনিস যখন বাংলাদেশে ঢুকে যেতে পারে তখন সহজেই অনুমেয় সীমান্তের পাহারা কতটা মজবুত। এই চোরা চালান নাকি প্রতিদিন প্রতি ট্রেনেই হয়ে থাকে, জানিনা কম্বল বা থালা বাটির ফাঁকফোকরে আরও কি কি চালান হয়ে যাচ্ছে। যারা এই মাল পত্রের পাহারাদার হয়ে বসে রয়েছে তাদের চেহারা দেখে মনে হয়না এরা এই চোরা চালানের আসল চক্রী বা মালিক। পরে জানলাম আমার অনুমানই ঠিক। এই নিতান্ত সাদামাটা জীর্ণ চেহারার মানুষগুলো আসলে ভাড়া খাটা মজুর। পুলিশ কিংবা বিআরডি-এর তাড়া খাওয়া সারাদিনের পরিশ্রমের বিনিময়ে এরা নাকি পায় বড়জোর ৫০০ টাকা। উপরি পাওনা হিসাবে মাঝে মাঝেই জুটে যায় জেলের ভাত। বিএসএফ কিংবা বিআরডি যখন মাঝেমধ্যে অতি সক্রিয়তা দেখায় তখন কারো কারো কপালে গুলিও যায় জুটে। নিজের পরিবার ছাড়া কেউ আফসোস করে না এদের জন্য। কয়েকদিন থমথমে থাকার পর আবার যথারীতি চলতে থাকে একই কাজ। নিয়োগ হয় নতুন কোনো মুখ। আসল মালিক হয়তো তখন ছুটি কাটায় বিদেশে। অবশ্য এ ঘটনা নতুন কিছু নয়, পৃথিবীর সবজায়গাতেই এমনটা ঘটে।
ক্রমশ…