দ্বিতীয় পর্ব
গতকাল ট্রেন জার্নি করে মনে হচ্ছিল আর ট্রেনে লং জার্নি করব না। এবার থেকে গাড়ি চালিয়েই ঘুরব। রাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। এদেশের লাইফ লাইন হোলো রেল। সেখানেই চূড়ান্ত অব্যবস্থা। একদল বাঁদর দেশ চালালে এমনটাই হয়। আজ সকালে একটু গড়িমসি করে বিছানা ছাড়লাম। বোন একটা ছোট্ট রাইস কুকার এনেছে। সেটা দিয়েই জল গরম করে কফি করলাম। সঙ্গে বিস্কুট খেলাম। তারপর গরম জলে স্নান করে বেড়িয়ে পরলাম। সেই লাভলি প্রীতম ধাবাতেই খেলাম বাটার সে বনা আলুকা পারাঠা। সঙ্গে দিল দহি আউর আচার। ওরা পেঁয়াজ, আদা ও ধনেপাতা বাটা দিয়ে একটা সুন্দর জিনিস দেয় খাবারের সাথে।
তারপর ঠান্ডা ঠান্ডা মৌসমকে বিচ্ মে পয়দল গেলাম স্বর্ণমন্দির অঞ্চলে। প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে মন্দ লাগল না। রেললাইনের উপর ফ্লাইওভার ধরে একেবারে শেষ প্রান্তে এল শহীদ উধম সিং এর মূর্তিবসানো একটা গোল বা আইল্যান্ড। সামনেই হল গেট, ১৮৩৬ সালে নির্মিত। এল হল বাজার। দোকানগুলো সবে খুলতে শুরু করেছে। চোখে পড়ল পাকিস্তানি জামাকাপড়ের দোকান। হবেই তো। পাকিস্তান-হিন্দুস্তান আবার কি? এভাবে দেশ ভাগ করা যায়? কতো যে ক্ষতি হয়েছে এই অমৃতসর শহরের! হস্তশিল্পীরা চলে গেছে ওপারে। ব্যবসা বাণিজ্যের দফারফা! কতো মানুষ মারা গেছে বৃটিশলালিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়!
এসব আরো অনেক কিছুই জানতে পারলাম হল বাজারের শেষে দ্বিতীয় হল গেটের সামনে নির্মিত পার্টিশন মিউজিয়াম দর্শন করে। দশটাকা করে প্রবেশমূল্য। দেখি বাংলা ভাষায় শ্বেত পাথরের ফলকে লেখা পার্টিশন মিউজিয়াম। দেখতে দেখতে একটা ঘরে দেখি “আমার সোনার বাংলা” গানটা বাজছে। সেই ঘরে বাংলাভাগ ও পরবর্তিতে দাঙ্গায় মানুষের ক্ষয়ক্ষতির বিভিন্ন ছবি প্রদর্শিত। বাংলা ও পাঞ্জাবের বুকচিরে ওরা নিয়ে এসেছে এই স্বাধীনতা। একটা ইঁটের দেওয়ালের মাঝখান দিয়ে একটা বিরাট বড় আকারের করাত দেওয়ালটাকে দ্বিখন্ডিত করছে- এই অনবদ্য বিষয়টাকে ক্যামেরা বন্দী করতে পারলাম না ছবি তোলার কড়া নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকার জন্য। আরো অনেক কথা, লিখে শেষ করা যাবেনা। লিখেইবা কি হবে? তবে, যে বজ্জাতগুলো এখন হিন্দু হিন্দু করে আবার প্রয়োজনে হিন্দুদের উপরই অত্যাচার করছে, সেইসব শয়তানগুলো এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সম্পূর্ণ নীরব ছিল, সেটা এই মিউজিয়াম বা এরপর দেখা জালিয়ানওয়ালাবাগের চারটে গ্যালারি দেখে ভালো বোঝা গেল।
আমি তৃতীয় বার এখানে এলাম। সমস্ত এলাকাটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের অনেক আগে থেকেই যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দুপাশে বিভিন্ন মার্কেট, বিক্রেতাদের হাঁকডাক, ওয়াগা বর্ডার নিয়ে যাওয়ার জন্য জোচ্চর দালালদের হুটোপুটি। জালিয়ানওয়ালাবাগের সামনে একটা শহীদ স্মারক স্তম্ভ করা হয়েছে। ঢোকার মুখে শহীদ গলিতে দু’ধারের দেওয়ালে শহীদদের বিভিন্ন মূর্তি খোদিত, সঙ্গে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। সম্পূর্ণ বাগকে প্রকৃত অর্থেই বাগান করে ফেলা হয়েছে। বাঁদিকে পরপর তিনটে ও ডানপাশে একটা গ্যালারিতে অডিও ভিসুয়াল শো সহ বিভিন্ন শহীদদের ছবি প্রদর্শিত। সেই ভয়াবহ দিনটার ইতিহাস, তার সাক্ষীদের বয়ান, পরবর্তি জনরোষ ইত্যাদি দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে সবিশেষ সম্মানিত।
বোনকে সব ঘুরিয়ে ইংরেজি নিষ্ঠুরতার বিভিন্ন উদাহরণ দেখালাম। গুলির দাগ, শহীদ কুঁয়ো, শহীদ স্তম্ভ ইত্যাদি। ওখান থেকে বেরিয়েই গ্লাস প্রতি পঞ্চাশ টাকায় খেলাম অমৃতসরি অমৃত লস্যি। তারপর তিনশো মিটার হেঁটে এলাম স্বর্ণমন্দির চত্বরে। আজ লাখখানেক মানুষের জমায়েত। প্রায় সোয়া দু’ঘন্টা আঁকাবাঁকা লাইনে অপেক্ষার পর মূল মন্দিরে প্রবেশের সুযোগ পেলাম। এই দীর্ঘ অপেক্ষাকালে ভক্তদের মুখে একটাই লাইন- সতনাম ওয়াহে সদ্গুরু। অর্থ অজানা। আমার কাছে অর্থহীন। কিসের জন্য এই ভক্তি? কি পেল এরা? কোটি কোটি টাকা নগদে ও জিনিসপত্রে জমা দিচ্ছে ভক্তরা। আত্মসাৎ করছে একদল প্রতারক। সারা দেশব্যাপী এই গোষ্ঠীর বিপুল ক্ষমতা। ভক্তরা আন্দোলন করলে লাঠি, গুলি, কাঁদানে গ্যাস চলে। তখন কোথায় নানকের বা রামদাসের মাহাত্ম্য? তখন কোথায় থাকে স্বর্ণমন্দিরের ট্রাস্ট?
আমি গেছি বোনকে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশের এই মন্দির দেখাতে, যেখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও মানবসেবা হচ্ছে ধর্মের একটা অঙ্গ। আর ক্রমাগত একটার পর একটা খাঁটি সনাতনী সঙ্গীতের রাগাশ্রয়ী গান পরিবেশিত হচ্ছে। পুরিয়াকল্যাণ, বসন্ত্ ইত্যাদি রাগাশ্রয়ী কয়েকটা গানের সুর মন ছুঁয়ে গেল। এসবই মানুষের সৃষ্টি। বিশ্বাসটা অন্যত্র। মন্দিরকে সামনে রেখেই প্রকৃত অর্থে কলেবরে বর্ধিষ্ণু হচ্ছে অমৃতসর। মন্দির দর্শনের সমাপ্তিতে দেশি ঘিয়ের সুজি বা হালুয়ার স্বাদ প্রাপ্তি কিন্তু অনন্য। কোনওমতে খাওয়াদাওয়া সারলাম স্বাগত ধাবায়। সেই পাঞ্জাবী থালি। দুটো মাখনরুটি, লচ্ছা পরোটা, ভাত, তরকার ডাল, পনির বাটার মশলা, টকদই, পেঁয়াজ-আদা-ধনেপাতা-গাজরের স্যালাড। তারপর দুশ দুশ চারশো টাকায় অটোর ঝক্করানিতে প্রায় পঁয়ত্রিশ কিমি দূরের ওয়াগা সীমান্তে গেলাম ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগির স্বাদ গ্রহণ করতে।
ছবি- লেখক
ক্রমশ…