(গত সংখ্যার পর)
তার একাত্ম হয়ে বাঁশি বাজানো দেখে চাটুজ্যে বাড়ির ছোট কর্তার বড় ছেলে সরাসরি মঞ্চে উঠে লখাইকে জড়িয়ে ধরলো। রুদ্রকে ইশারা করে একটা রজনীগন্ধার সঙ্গে গোলাপ মেশানো মালা আনতে বললো। মঞ্চের নীচে টেবিলে রাখা একটা মালা রুদ্র এনে তাদের প্রিয় বড়দা সূর্য শেখরের হাতে দিল। এবার মাইকে ডাকা হলো এই বংশের প্রবীন মানুষ মনি শেখরের নাম। তিনি ছড়িতে ভর দিয়ে মঞ্চে উঠলেন। এখনোও শক্ত সামর্থ্য তিনি। পৌরুষদীপ্ত চেহারার মনিবাবু সপরিবারে প্রবাসী ভারতীয় হয়ে দীর্ঘকাল উত্তর আমেরিকার আটলান্টা প্রদেশে থাকেন। সবচেয়ে অভিজাত অঞ্চল বলে খ্যাতি আছে। তার উপর জর্জিয়া রাজ্যের রাজধানী এই আটলান্টা। ক্রশ কী নামের একটি জনপ্রিয় মেট্রোপলিশের ক্লীভল্যান্ড হার্ট ফাউন্ডেশনের কনসালটেন্ট সার্জেন। মনি শেখরের স্ত্রী সামান্থাও একজন নামকরা সার্জেন। কোলকাতায় ডাক্তারি পাশ করে বাবার ইচ্ছে পূরণের জন্য প্রথমে বিলেতে গেলেন। সেখান থেকে মার্কিন দেশের অন্যতম সেরা মেডিকেল কলেজে হাউস স্টাফ থেকে ইন্টার্ণশিপ করে সেখানেই জুনিয়র সার্জেন হিসেবে কাজ শুরু করলেন। তাঁর সহপাঠী তরুণী সামান্থা’র সঙ্গে গাঢ় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সামান্থা আইরিশ মেয়ে হলেও তার মা বনেদী বাঙালি ব্রাম্হণ ঘরের মেয়ে। তার বাবা উত্তর আয়ারল্যান্ডের একটি প্রদেশের রাজ পরিবারের সন্তান। তিনি মার্কিনী ব্যাঙক পরিচালন সমিতির মূখ্য প্রশাসক। সামান্থা ও মনিশেখর পড়াশোনা থেকে চাকরি করার সময়েই দু’জনের প্রেম হয়। প্রেম থেকে দুজনের পরিনয় ঘটে। বনেদী জমিদার বাড়ির ছেলের বিদেশিনী বউয়ের খবরে গোটা গ্ৰাম তোলপাড় হয়ে যায়। চারিদিকে গুঞ্জন ওঠে চাটুজ্যে বাড়ির এই মেমসাহেব বউকে ঘিরে।
এই মনিশেখরই একদিন বাঙলা বাঙালির শিল্প সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন সুদূর মার্কিন মুলুকের মাটিতে। তরুণ বয়সে এখানকার ছো নাচ, রণপা, ঢাকি, বাউল, পটুয়া, পোড়ামাটির শিল্পী, কবিগানের দল নিয়ে যেতেন প্রতিবছর। রাঢ়বঙ্গের কবি সাহিত্যিক, লেখককেও নিয়ে যেতেন সসম্মানে। বাঙালি সেলিব্রেটিদের একটি অন্যতম গন্তব্য ছিল ক্লীভল্যান্ডের বাঙালি সমিতি।সেখানে প্রথম দুর্গোৎসব থেকে কালী, সরস্বতী পূজার আয়োজন করেন তিনিই। ক্লীভল্যান্ডের বেঙ্গলি এসোসিয়েশনের তিনিই চালিকাশক্তি ছিলেন। আজ থেকে অন্তত পঞ্চাশ বাহান্ন বছরের কথা। সেই ধারাকে আজও ধরে রেখেছে পরবর্তী প্রজন্ম। এ হেন বর্ণময়, বৈচিত্র্যময় সুপুরুষ মনিবাবু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন লখাই-এর দিকে। স্পষ্ট দেখতে পেলেন এই ছেলেটির আগামীর উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল লখাই। পা ছুঁয়ে প্রনাম করলো মনিবাবুকে। মনিবাবু তার মাথায় হাত রেখে বললেন, তোমার ভাগ্য তোমাকেই গড়তে হবে। গাঁয়ের, মা বাবা ও সংসারের পিছুটান থাকলে হবে না। নিজের সাধনা আর প্রতিভাকে মেলে ধরতে হবে বিশ্ব মাঝারে। আরও ভালো করে শিখতে হবে, পড়তে হবে। তালিম নিতে হবে তোমার সার্বিক উন্নতির জন্য। সূর্য শেখর তাঁর হাতে কর্ডলেস মাউথপিস দিতেই তিনি দেবী সূক্ত থেকে স্তোত্র উচ্চারণ করে সবাইকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন। প্রাসঙ্গিক দু’চার কথা বলে বাঙলা বাঙালির শিল্প সাহিত্য, কৃষ্টি সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি বললেন- আমরা অমৃতের সন্তান। আমরা যেমন মাতৃসাধক তেমনি শিল্প সংস্কৃতির সাধকও। নিজের পরিবার পরিজনদের কথা বললেন। বংশের পরবর্তী প্রজন্মের কথা বললেন। আরও বললেন তার পরিবারের সন্তান সন্ততি ছড়িয়ে আছে আবিশ্ব। বলে চলেছেন ঠাকুর মা আর স্বামীজীর কথা। সুগম্ভীর গলার সঙ্গে বাচনভঙ্গির মাধূর্যে সবাই এক মনে শুনছে। কারও কোনো টুঁ শব্দ নেই।
ক্রমশ