দশমীতে দুর্গা পুজো শেষ। দশমী পর্ব মিটলেই শুভ বিজয়া। এর দু’দিন পর বাঙালির ঘরে ঘরে লক্ষ্মী পুজো। কিন্তু একাদশীতে উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জায়গায় নতুন করে শুরু হয় দেবীর বোধন, সেটিও আর এক উৎসব। মূলত উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার কয়েকটি গ্রামে ভান্ডানি দেবীর পুজো ঘিরে হয় এই উৎসব। একে আঞ্চলিক উৎসব বলা যেতে পারে। দশমীতে দেবী দুর্গা বিসর্জনের পর চারপাশে যখন এক স্তব্ধতা এসে ভর করে। তখন জলপাইগুড়ি জেলার রাজবংশী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে নতুন করে আরেক উৎসবের সুচনা হয়। একাদশীর সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ভান্ডানি পুজো। এই মুহুর্তে ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, মালবাজার, এমনকি আলিপুরদুয়ার এবং পার্শ্ববর্তী কোচবিহার জেলার বেশ কিছু গ্রামেও ভান্ডানি পুজো ঘিরে চলছে উৎসবের আমেজ।

এক সময় কেবলমাত্র রাজবংশী সম্প্রদায়ের কৃষকরাই ভান্ডানি পুজোকে ঘিরে উৎসবে মেতে উঠত, এখন সেই উৎসবে উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের সব সম্প্রদায়ের মানুষই তাতে অংশগ্রহণ করে। ভান্ডানি দেবী দুর্গার আরেক রূপ। একাদশী থেকে চারদিন ধরে চলে এই উৎসব। সূচনা হয় দশমীর দিন ‘যাত্রা পুজো’দিয়ে। শরতের পর হেমন্ত ঋতুতে যাতে চাষাবাদ ঠিকঠাক হয়, ভাল ফসল মেলে, তার জন্য কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় যন্ত্র- কাস্তে, লাঙল, মই প্রভৃতির পুজো হল‘যাত্রা’। আর তার পরের দিন থেকে শুরু হয় ভাণ্ডানী দেবীর বন্দনা।

ভান্ডানিকে কেউ দেবী দুর্গার অপর রূপ বলেন, কেউ বলেন বনদুর্গা। তাই উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের কোথাও কোথাও বনবস্তিবাসীরা ভান্ডানিকে বনদুর্গা রূপে পুজো করে। তবে রাজবংশী সমাজে ভান্ডানি ঘিরে একটি লোককথা রয়েছে। কথিত আছে, বিসর্জনের পর দেবী দুর্গা উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চল দিয়ে গ্রাম্যবধূবেশে বাপের বাড়ি থেকে কৈলাসে ফেরার সময় রাতের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ফেলেন। গভীর রাতে জঙ্গলের ভেতর থেকে নারী কন্ঠে কান্নার শব্দ শুনে ছুটে আসে আশপাশের বনবস্তির মানুষ। তারা সেই রাতে নিজেদের গ্রামে আশ্রয় দেয় পথ হারিয়ে ফেলা গ্রাম্য বধূটিকে। একটি রাত দেবী দুর্গা সেই গ্রামে কাটিয়ে ফিরে যান কৈলাসে। যাবার আগে অবশ্য তিনি গ্রামবাসীদের নিজের প্রকৃত পরিচয় জানান। তিনি এও বলেন, তিনি গ্রামবাসীদের আতিথ্যে সন্তুষ্ট হয়েছেন। উত্তর বাংলার অরণ্যবেষ্টিত গ্রামের মানুষের শস্যের ভান্ডার সারা বছর ভরা থাকবে। সেই থেকেই এখানে দশমীর পর ভান্ডানি পুজোর সূচনা।

উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি অঞ্চলের বার্নিশ গ্রামপঞ্চায়েতের ভান্ডারি গ্রামের ভান্ডানি পুজো সবথেকে প্রাচীন বলে ধরা হয়। প্রায় পাঁচশো বছর ধরে এই গ্রামে পুজো চলছে। পুজো উপলক্ষ্যে বসে বিরাট মেলা। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ভিড় জমায় এই পুজোতে। দুর্গাপুজোর মতেই চার দিন চলে ব্যাঘ্রবাহিনী ভান্ডানি পুজো। পুজোও হয় তন্ত্র মতে। ভান্ডানি পুজো নিয়ে আরেকটি লোককথা প্রচলিত আছে। সেতি হল- দুর্গা কৈলাসে পৌঁছেও আবার মর্তে ফিরে আসেন। ফেরার পথে হিমালয়ের পাদদেশে একদল রাখালকে তিনি বাঘের ভয় দেখান। রাখালরা ভয় পেয়ে তাঁর পুজো করে। এটা সোজা পথ নয়, ভয় দেখিয়ে বা ঠকিয়ে পুজো আদায়। লোককথা অনুযায়ী ভন্ডামি করে পুজো নেওয়া, তাই এই পুজোকে ভান্ডানি পুজো বলা হয়। উত্তরবঙ্গের কোথাও কোথাও ভান্ডানি দেবীর নামে পায়রা উড়িয়ে দেওয়ার রীতি আছে কোথাও পাঁঠা বলিও দেওয়া হয়।
উত্তরবঙ্গের ইতিহাস থেকে এই সূত্র মেলে, উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা ভান্ডানি দেবীর পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণের কামরূপ জয়েরও পাঁচশো বছর আগে। তখন দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে হলে রাজাকে জানাতে হত, তিনি সম্মতি দিলে তবেই তা করা যেত। তাই দুর্গাপুজোর বিকল্প হিসেবে ভান্ডানি পুজোর প্রবর্তন করেছিলেন। সেই ঐতিহ্য আজও রাজবংশীরা বজায় রেখেছে। দুর্গা বিসর্জনের পর উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সসমাজে যে ভান্ডানি পুজো ঘিরে উৎসব সেই দেবী মহিষাসুর মর্দিনী নয়, তাঁর রূপ একজন সাধারণ নারীর। দেবী ভান্ডানি দুর্গা হলেও দ্বিভুজা।তার বাহন বাঘ, কারণ বৈকন্ঠপুর জঙ্গলাকীর্ণ এলাকা হওয়ায় তিস্তা পারের এই অঞ্চলে একসময় প্রচুর বাঘ ছিলো।কথিত তাই দেবী ভান্ডানি বা দুর্গা সিংহের বদলে বাঘের উপর অধিষ্ঠিতা। দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ থাকেন। কিন্তু এই মূর্তিতে অসুর থাকে না।