(গত সংখ্যার পর)

নির্জন দুপুরে বৈঠকখানায় গল্প শুনতে শুনতে অন্যদের মতো আমারও ঘুম চলে এলো। দুপুরের ভাত ঘুম নয়, সকাল থেকে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তির জন্যই এই ঘুম। তাছাড়া তপ্ত বেলারও প্রভাব এই পরিবেশের উপর থাকবে নিশ্চিত। এই সময়টায় এরকমই হয় বলে জানালো গৌরহরি। সে আর কথার পিঠে কথা বাড়ায় না। সে নিজেও দড়ির খাটিয়ায় শুয়ে পড়ল আমাদের মতোই। বিকেলে উঠে গোয়ালে গিয়ে দুধ দোয়া, সন্ধ্যা আরতি করতে হয় নিজেদের ও চাটুয্যেদের মন্দিরে। এটি তাদের দু’তিন পুরুষ ধরে করে আসছে। সকালেই বাল্যভোগ, দুপুরে অন্নভোগ আর রাতে ফল, মিষ্টি ও চিঁড়ের ভোগ নিবেদন করা হয়। অন্নভোগ তাকে করতে হয় না। তাদের পরিবার থেকেই ব্যাবস্থা করেছেন এক অকাল বিধবা যুবতীকে। তার মুখে সেই মর্মন্তুদ কাহিনি শুনে আমরা একদিন গৌরহরির সঙ্গী হয়েছিলাম। সেই নাটকীয় ও রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়।

সেদিন আমরা কাক ভোরেই ঢুকে পড়ি চর্যা পথের পদাবলী শোনার উদ্দেশ্য নিয়েই। সেই দিনটিও ছিল এমনই তাপিত তৃষিত বেলা। আমরা আগেই চলে এসেছিলাম জামতল গোড়ায়। ঠায় বসেছিলাম মোটা একটা গাছকে বেড় দেওয়া বাঁশের মাচায়। দু’তিনটে কাঠ ও বাঁশের বেঞ্চও আছে আগন্তুক কিম্বা পথচারীদের বসার জন্য। অনেকটাই কাছে চলে এসেছে গৌরহরি। মাথায় উত্তরীয় দিয়ে পাগড়ি বাঁধা। গায়ে হাফ্ পাঞ্জাবি আর ধুতি। গলায় ঝুলছে পাল্লা চাদর। পায়ে সাধারণ চটি। কাছাকাছি এসেই সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেই প্রশ্নের মুখে পড়েছে গৌর। গলা থেকে হারমোনিয়াম নামিয়ে রাখলো বাঁশের বেঞ্চিতে। গাছতলায় বসে থাকা এক স্বাস্থ্যবতী যুবতী আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে বসলো গৌরকে – কুথায় চল্ল্যে গো রসিক গুঁসাই?
– রসের সন্ধানে চললাম গো রসিকজন!

টুকচ্যা থাম দেখি গুঁসাইজী! দু’কলি কীত্তনের পদ শুনাও আমদের। আগে টুকুন তামুক সেবা কর জামতলের ছাওয়ায় বস্যে! এই লাও তামুক। কাল্লা তার বাবার জন্য কেনা একতাড়া বিড়ি থেকে একটি এগিয়ে দেয় গোঁসাইজীর দিকে। বেশ গুছিয়ে কথা বলে গাঁয়ের মেয়ে কাল্লা, কাল্লাবতী। শিলাইজোড় গাঁয়ের সব মানুষই কাল্লা বলেই ডাকে। কাল্লা ভালো গান গায়। নাচও জানে সে। ছোটবেলা থেকেই গাঁয়ের বালিকা সঙ্গীত দলে কাল্লা অভিনয় করতো। গাঁয়ে গাঁয়ে বালিকা সঙ্গীতের আসর বসতো বেশ জমকালো ভাবে। কোনও দিন কালীয় দমন, নৌকাবিলাস, মনসামঙ্গল পালা পরিবেশন করতো তাদের দল। পালাগুলোতে শ্রীমতী রাধারানী, বেহুলা কিম্বা রামীর ভূমিকায় সাবলীল অভিনয় করতো কাল্লাবতী। তার বাবা রসরাজ দাস ছিল মূলগায়েন। দল ম্যানেজার হিসেবেও সব কাজ করতে হতো তাকে। কিশোরী থেকে যুবতী হয়ে ওঠা এ হেন কাল্লাকে দল ছাড়তে হল বাধ্য হয়েই। তার মা একপ্রকার জোর করেই বালিকা সঙ্গীতের দল থেকে বের করে আনে।

পাড়ায়, ঘরে নিন্দা মন্দ কম শুনতে হয়না তাকে। মা হয়ে কতজনের মুখ আটকাবে? সোমত্ত মেয়ের ধিঙ্গিপনা করে পালাগানের আসরে ঘুরে বেড়ানো একেবারে পছন্দ ছিল না দাদু ঠাকুমার। তাদেরও ইচ্ছে ছিল, যতদিন না কন্ঠিবদল হয় ততদিন ঘরে বেলমালা, তুলসীমালা ও কুঁড়চিমালা কাটুক। দুটো পয়সা আসবে এই অভাবের সংসারে। গাঁয়ের সব লোকই এই কাজ করে সংসার চালায়। কাছে দূরের বাজার শহরে এমনকি বৃন্দাবন, মথুরা, নবদ্বীপ, মায়াপুর থেকে মালা কারবারির দল চলে আসে এখানে। শিলাইজোড়, ধ্বতলা, হেঁসলা-সহ বহু গ্ৰামের মানুষ এখন এই মালা কেটে সংসার চালায়। মহাজন, ফড়ের দল এখন আর আসে না। মহাজনী দাদনের ফাঁদ আজ ছিঁড়ে পড়েছে। গাঁয়ে গাঁয়ে গড়ে উঠেছে স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সবাই টাকা জমায়, ঋণ নেয়। প্রত্যেকেই ব্যাঙ্কে যায়। নিজেদের কাজ নিজেরাই করে।
(পরবর্তী অধ্যায় আগামী সংখ্যায়)