মোজাম্বিক-দ্বিতীয় পর্ব
সেই মুলুকে কাজ শুরু করতে হতো সকাল সকাল। কারণ বেলা তিনটের মধ্যে কাজ গুটিয়ে ফিরতে হতো ক্যাম্পে। যাহা ব্রেকফাস্ট, তাহাই লাঞ্চ। সকালের খাবার বলতে বানানো হতো মাসা। সঙ্গে অল্প বাঁধাকপি, পেঁয়াজ, কিছু সব্জি আর মেয়োনিজে বানানো হতো স্যালাড। সঙ্গে কফি। রুটি বা ভাত নয়, মাসা-ই ওখানকার মূল খাবার। ভুট্টার আটাকে মেখে তৈরি হতো সুজি বা ছাতুর মতো একটা ভারি মন্ড। তা থেকেই তৈরি হতো মাসা। গাড়ির আর জেনেরটারের তেল, খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য দিন ১৫-২০ বাদে বাদে যাওয়া হতো টেটে। আনা হতো টিনফুড। টিনফুড বলতে সেখানে মিলতো সার্ডিন, ট্রাউট কিম্বা বিফ। টিনফুড শেষও হয়ে যেত। আর তা খেতে খেতে জিভে চরাও পরে যেত। ডিনারে প্রায় রোজই হতো মাংস। মাংস মানে প্রধানত কুডুর (এক ধরণের হরিণ) মাংস। টিমে কুক ছিল। রান্না হতো কাঠের আঁচে। কুকই রোজ বিকেলে বানাতো সেই কুডুর ঝলসানো মাংস। সঙ্গে সেই মাসা, স্যালাড আর কফি। স্থানীয় মানুষেরা কুডু শিকার করতো। তাঁদের কাছ থেকেই মিলতো ওই মাংস।
একবার দিয়েছিল কুমিরের মাংসও। কুক যখন কুডু ঝলসাতে ব্যস্ত থাকতো, আমরা হয়তো হাতে হাতে স্যালাড বানানোর কাজটা সারতাম। কারণ সময় খুব কম। সন্ধ্যার মধ্যেই সারতে হবে রাতের খাওয়ার পর্ব। তারপর টেন্টের বাইরে থাকাটা আদৌ নিরাপদ নয়। আলোর কোনো ব্যবস্থা নেই সে প্রান্তরে। আমাদের সঙ্গে জেনেরেটার ছিল বটে। কিন্তু তা চালানো হতো দিনে ঘণ্টা খানেক থেকে বড়জোর ঘন্টা দেড়েক। তারমধ্যেই সারতে হতো ল্যাপটপ থেকে মোবাইলে চার্জ দেওয়ার কাজ। তখন মনে হতো আমাদের রাজ্যের পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনিপুর, বাঁকুড়ার সেই গ্রামগুলোর কথা। সেখানে দিন শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে আর শেষ হয় সূর্যাস্তে। ঘরে কেরোসিনের একখানি বাতি জ্বালানোও যাদের জীবনে বিলাসীতা। ডিনারের পর বাসন কোসন নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে যে যার টেন্টে। চারপাশের এলাকাটিতে তখন জ্বালিয়ে রাখতো হতো আগুন। তা জলতো রাতভর। রাতে মাঝেমধ্যেই গ্রাম থেকে ভেসে আসতো মাদল জাতীয় এক বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ আর সঙ্গে উচ্চগ্রামে কিছু আওয়াজ আর সুর। জেনেছিলাম, ওটাই ছিল ওখানকার মানুষের প্রার্থনার রীতি।
জীবন সেখানে সত্যিই বড় কঠিন। স্নান করতে যেতে হতো আধঘন্টা হাঁটা পথ পেরিয়ে নদীতে। ওখানকার নদীগুলোতে জল থাকে না। আগে গিয়ে নদীর বুকে গর্ত খুঁড়ে আসতাম। পরদিন সেখান থেকেই জল তুলতে হতো। দশ মিনিট অপেক্ষার পর মিলতো এক বালতি জল। এরকম ভাবে তোলা জলেই সারতে হতো স্নান, জামা কাপড় কাচাকুচি। ফের সেই পথে হেঁটেই ক্যাম্পে ফেরা। রান্না, বাসন মাজা আর খাবারের জল সংগ্রহ করতে যেতে হতো সপ্তাহে একদিন। গাড়িতে ঘন্টা খানেকের পথ পেরিয়ে। পালা করে তা আনতে যেতে হতো অফিসার থেকে লেবার সবাইকেই। যেদিন জল আনা হতো ড্রাইভার ছাড়াও সঙ্গে থাকতো একজন অফিসার এবং একজন লেবার। ২০ লিটারের ডজন খানেক ক্যানেস্তরা ভরে আনা হতো জল। তা খরচও করতে হতো খুব হিসেব করে। কারণ ওই জলে চালাতে হতো সপ্তাহ খানেক।
জিওফিজিকাল সার্ভের জন্য পার্মানেন্ট স্টেশনটা করতে হয়েছিল লোকালয় থেকে এক কিলোমিটার দূরে। যাতে সেখানে কোনো কম্পন না পৌঁছায়। যন্ত্র বসিয়ে সেখানে সকাল থেকে বিকেল নানা তথ্য রেকর্ড করতে হতো ঘন্টায় ঘন্টায়। সঙ্গে থাকতো স্টপ ওয়াচ। ওখানে যার ডিউটি পড়তো তাঁর খাবার পৌঁছে দিতো কুক-ই। সেদিন আমার ডিউটি ছিল না। ছিল এক সহকর্মীর। রেকর্ড তুলে রেখে ডেক চেয়ারে বসে সে একটা বই পড়ছিলো মনোযোগ সহকারে। আশেপাশের অন্যকিছুই খেয়াল করেনি। খাবার দিতে গিয়ে কুক দেখে ওই চেয়ারের পেছনে লেজের ওপর ভর করে ফনা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে একখানা ব্ল্যাক মাম্বা। এই ধরণের পরিস্থিতির সঙ্গে সে পরিচিত। তবুও সেও ঘামতে লাগলো
কারণ একটু নড়লেও ছোবল মারবে মাম্বা। আর জীবন থেকে মৃত্যুর পথে পাড়ি দিতে তার একটা ছোবলই যথেষ্ট। কোনোরককমে আকারে ইঙ্গিতে সে আমার ওই সহকর্মীকে বারণ করলো একচুলও না নড়তে। কথা বলা তো দূর অস্ত। তারপর বড় একটা লাঠির সাহায্যে মারলো ব্ল্যাক মাম্বার লেজে এর বারি। সে যাত্রায় রক্ষা মিললো বিরাট এক বিপদের হাত থেকে। ও ফেরার পর শুনে মনে এলো সেই চাঁদের পাহাড়ের কথা। উপান্ডায় যখন ব্ল্যাক মাম্বার মুখোমুখি হয়েছিল শঙ্কর কিসুমু থেকে তিরিশ মাইল দূরের সেই ছোট্ট স্টেশনে। কৈশোরে তা পড়েই লোমখাড়া হয়ে যেতো আমার। আর এখন নিজেরাই তার খপ্পরে।
শুধুমাত্র সাপই তো নয়, বিষাক্ত আরো নানা পোকা মাকড়ও রয়েছে সেখানে। গাড়ির ওপর যে টেন্টগুলো খাটানো হতো তার খুঁটগুলো বাঁধা থাকতো নিচে মাটিতে। এক রাতে দেখলাম, একটা খুঁট খুলে গিয়েছে। সেটা ঠিক করার জন্য রাতে নেমেছি নিচে। শক্ত করে তা বাঁধার পর পায়ে যেন কি একটা কামড়ালো। অসহ্য যন্ত্রনা। সঙ্গে থাকা টর্চ জ্বেলে দেখা গেল একটা কাঁকড়া বিছে। তার বিষও সাপের থেকে কম কিছু নয়। সে রাতেই সহকর্মীরা ঘন্টা দেড়েক দূরে নিয়ে গেল নিকটতম স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সেখানেই আমাকে দেওয়া হলো এন্টিভেনম ইঞ্জেকশন। পরের দুদিন প্রবল জ্বর হলেও উদ্ধার পেয়েছিলাম সে যাত্রায়।
ওই যে বলছিলাম, স্থানীয় মানুষেরা তাদের অভিজ্ঞতার কারণেই বিপদের আঁচ খানিক আগেই পায়। একবার প্রত্যক্ষ করেছিলাম সে অভিজ্ঞতাও। সেবার ডাক পড়লো জেলা সদরে। তাও গাড়িতে ঘন্টা আটেকের পথ। রাস্তাও অচেনা। গুগল ম্যাপের ওপর ভরসা করে রওনা দিলাম। ড্রাইভার, দোভাষী, আমি আর আমাদের টিমের একজন যার ম্যালেরিয়া হয়েছিলো। সে পেছনে শুয়ে। তাকে পাঠানো হবে জেলার হাসপাতালে। জঙ্গলের পথ ধরেছে গাড়ি। সামনে নদী। যদিও তাতে জল নেই। তত দিনে সে দৃশ্যের সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে গিয়েছি। নদী পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের। হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ির স্টার্ট অফ করে দিলো। জানতে চাইলাম, কি ব্যাপার? ড্রাইভার শুধু মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বললো। কিছুই বুঝতে না পেরে চুমুক দিলাম সঙ্গে রাখা কোকের ক্যানে। আফ্রিকার ওই প্রত্যন্ত গ্রামেও দেখেছি, খাবার, শিক্ষা, পুষ্টির উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকলেও গ্রামের কুঁড়ে ঘরের মতো দোকানেও মেলে কোক। বহুজাতিক সংস্থার এমনই বিপণন এবং নেটওয়ার্ক। আর মেলে রামও। কোকে চুমুক দিয়ে সে কথা ভাবতে না ভাবতেই সামনে তাকাতে হাড়হিম হয়ে যাবার উপক্রম। চার হাত দূরে নদী পেরোচ্ছে সাত আটটি সিংহের একটি দল। তাদের অবশ্য কোনো হেলদোল নেই। তারা নদী পেরিয়ে যাওয়ার পর ফের গাড়িতে স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।
(শেষ)