ঐশ্বর্যা সরকার, মেলবোর্ন
চোখে বড় স্বপ্ন ও বুকে ভয় নিয়ে ২০১৮-র জুলাই মাসে পাড়ি দিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়। গরমের দাবদাহ সহ্য করে যখন এমবিএ পড়ার জন্য মেলবোর্নের বিমানে উঠি, তখনও ভাবতে পারিনি, সে দেশে পৌঁছে ঠান্ডায় কাবু হতে হবে। জুলাইয়ের গরমে কলকাতাবাসী যখন হাঁসফাঁস করছে, তখন মেলবোর্নকে ঢেকে রেখেছে ঠান্ডার চাদর।
যাইহোক, এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম গন্তব্যের দিকে। এই শহরের রাস্তাঘাটগুলি বেশ চোখে পড়ার মতো, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে। কলকাতার রাস্তায় চিরাচরিত যে পানের পিক ও নোংরা দেখে অভ্যস্ত আমরা, তার বিন্দুমাত্র চোখে পড়ল না এখানে। ভাবতে শুরু করলাম, এতটা পরিষ্কার কোনও রাস্তা হতে পারে! পরিপাটি করে সাজানো পথঘাট, শহর দেখতে দেখতে পৌঁছলাম নিজের ঠিকানায়। এখানে একই ছাদের নিচে ছেলে ও মেয়ে দুজনেই থাকে। ছেলে-মেয়ের একসঙ্গে থাকা নিয়ে কোনও ছুৎমার্গও নজরে পড়ল না, সবই ভীষণ সাবলীল, সাধারণ— যেন কোনও ব্যাপারই নয়।
সেই রাতটি কাটিয়ে যখন ইউনিভার্সিটি যাই, তখন তাক লাগল আবার। পরিকাঠামো, ছাত্রদের জন্য সুযোগ-সুবিধা দেখে মুগ্ধ হলাম। এখানে সবকিছুই একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী করতে হয়, সকলে সেই নিয়ম পালনও করে। আমাদের দেশে নিয়ম থাকলেও, তা মেনে চলার গুরুত্বই অনুভব করেন না অনেকেই। কিন্তু এখানে তেমন নয়। হয়তো এ কারণেই অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থাও অনেকটা এগিয়ে। সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে। সময়ের দাম দিতে জানে সকলেই। এখানে পড়তে এলে চুরি বিদ্যা জলাঞ্জলি দিয়ে আসাই শ্রেয়। সমস্ত অ্যাসাইনমেন্ট চেক করা হয় যান্ত্রিক ডিভাইস দিয়ে। প্রতিটি লাইন চেক করা হয়। অন্য কারও সঙ্গে আপনার অ্যাসাইনমেন্ট মিলে যাচ্ছে কি না, সে সবই ধরিয়ে দেবে সেই যন্ত্র। আর যদি চিটিং ধরা পড়ে তা হলে সাসপেন্ড পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন। ছোট থেকে যে বাক্যটিকে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম, সেটি এখানে অপরাধ। আজ্ঞে হ্যাঁ, ‘চুরি বিদ্যা মহাবিদ্যা, যদি না-পড় ধরা’, এই বাক্যের কোনও মানেই নেই এখানে। পড়াশোনায়ে চুরি করাও এখানে অপরাধের পর্যাযেই পড়ে।
সকলকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে। সময়ের দাম দিতে জানে সকলেই। এখানে পড়তে এলে চুরি বিদ্যা জলাঞ্জলি দিয়ে আসাই শ্রেয়। সমস্ত অ্যাসাইনমেন্ট চেক করা হয় যান্ত্রিক ডিভাইস দিয়ে। প্রতিটি লাইন চেক করা হয়। অন্য কারও সঙ্গে আপনার অ্যাসাইনমেন্ট মিলে যাচ্ছে কি না, সে সবই ধরিয়ে দেবে সেই যন্ত্র। আর যদি চিটিং ধরা পড়ে তা হলে সাসপেন্ড পর্যন্ত হয়ে যেতে পারেন।
এ ভাবেই কেটে গেল ২টি বছর। এই দু’বছরে দেখলাম, এখানকার মানুষেরাও বেশ ভালো, সাহায্য করতে প্রস্তুত। এমন অনেক মানুষও আছেন, যাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে, জানতে চায়। আমাদের দেশে যেমন, এক শহর বা রাজ্যের মানুষদের সঙ্গে অনেকে মিশতে পারেন না, তেমনটি কিন্তু এখানে নয়। এখানে একে অপরে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি জানার জন্য এগিয়ে আসে।
থাক না আমাদের দেশে নানান সমস্যা, অন্য দেশের সঙ্গে আকাশপাতাল ফারাক, তবু আমাদের দেশের সংস্কৃতির জুরি মেলা ভার। পুজো-পাবর্ণে বাংলার সান্নিধ্যের অভাব আমাকে অনেকটাই একা করে দিয়েছিল। দুর্গাপুজোর সময় কলকাতা থেকে দূরে থাকতে কারই বা ভালো লাগে! এখানেও সবরকম উৎসব পালিত হয়। অস্ট্রেলিয়ার দুর্গাপুজোও দেখেছি একবার, পশ্চিম মেলবোর্নের শহরতলির দিকে বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন এই উৎসবের আয়োজন করে। তবে এই সব উৎসবই পালিত হয় সপ্তাহ শেষে, উইকডে-তে নয়। পুজো ভালোই লেগে ছিল, ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো গোছের। যদিও কলকাতার সঙ্গে এর তুলনা কোনও ভাবেই চলে না।
এবার আসি এখানকার নিরাপত্তার প্রসঙ্গে। সপ্তাহশেষে এখানে নানান ধরণের পার্টির আয়োজন হয়। আমি এমন অনেক পার্টিতেই গিয়েছি। অস্ট্রেলিয়ায় উইকএন্ড মানেই পার্টি। আমরা পার্টি করতে যেতাম প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে, কোনও ক্লাব বা বন্ধুর বাড়িতে। অধিকাংশ সময়েই ঘড়ির কাটা দেখতে ভুলে গিয়েছি। কিন্তু হুঁশ হলেই দেখি, ঘড়ির কাটা তখন রাত ২টো বা ৩টের আগমন জানান দিচ্ছে। এত রাতে বাড়ি ফিরতে ভয় পাইনি অবশ্য কখনও। চিন্তাতেও আসেনি, এত রাতে কী ভাবে বাড়ি ফিরব। কলকাতায় এটা অনেকক্ষেত্রেই ছিল কষ্টকল্পনা। এখানে উইকএন্ড পার্টির চল আছে বলে, প্রতি শুক্র ও শনিবার সারারাত ট্রাম চলে।
(চলবে)