উজ্জ্বল বিশ্বাস। ছবি: প্রতিবেদক
দাওয়াই পানি। নামটার মধ্যেই একটা বিস্ময় আছে। নামটা প্রথম বলেছিল আমার ফটোগ্রাফার বন্ধু কৌশিক। গরমের ছুটি শেষ হতে চলল, বেড়াতে যাব যাব করেও হয়ে উঠছিল না। একদিন কথা প্রসঙ্গে কৌশিক বলল, একটা জায়গার খোঁজ পেয়েছি।পাহাড়ি গ্রাম আর হোম স্টেতে থাকা। আমার এযাবৎ হোম স্টে-তে থাকার কোন অভিজ্ঞতা নেই। ভাবলাম একবার দেখাই যাক।
তৎকালে দার্জিলিং মেলে টিকিট কেটে রওনা দিলাম নিউ জলপাইগুড়ি । হোম স্টের মালিকের সাথে ফোনে কথা সেরেছি আগেই। তার একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে ঘর বুক করেছি। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গাড়ি পাঠিয়ে দেবে,এরম কথাও পাকা হয়েছে। ড্রাইভারের ফোন নম্বরও এসএমএসে এসেছে। সব কিছুই দিন দুয়েকের মধ্যে সারা হয়েছে।
নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের বাইরে এসে চা খেতে খেতে ফোন এলো, গাড়ি এসে গেছে।অত্যন্ত ভদ্র, হাসি মাখা মুখ নিয়ে শ্যাম দাজু হাজির।প্রাথমিক আলাপের পর আমরা রওনা দিলাম দাওয়াই পানির উদ্দেশ্যে । নতুন বোলেরো গাড়ি কিনেছে শ্যাম দাজু কিছুদিন হল। দাওয়াই পানিরই বাসিন্দা, বাড়িতে ছোট্ট মেয়ে আছে। আমার মেয়েকে তার খুব পছন্দ, মেয়ের কথা মত গান পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে গাড়ির স্টিরিওতে। মেয়ের কথা মতই সুকনা ছাড়িয়ে গাড়ি দাঁড়াল ব্রেকফাস্টের জন্য। কন্ডিশন একটাই, দোকানে মোমো পেতে হবে। ব্রেকফাস্টে মোমো খেয়ে মেয়ে খুব খুশি, আমরা পুরি সবজি খেয়েনিলাম।শুনলাম ঘন্টা চারেক লাগবে দাওয়াই পানি পৌঁছাতে । সুকনার জঙ্গল ছাড়িয়ে পাঙ্খাবাড়ির রাস্তা ধরলো গাড়ি, সবুজের সমারোহে চোখে তাক লেগে যায়। অনেক হেয়ার পিন বেন্ড টপকে টপকে এসে পৌঁছালাম কার্শিয়াং, উন্মুক্ত হলো বা হাতের দৃশ্য, নিচের দিকে তাকালে ফেলে আসা সুকনার রাস্তা, বয়ে চলা নদীগুলোর শিরা উপশিরা আর তার ওপর আলো মেঘের কাটাকুটি খেলা মোহবিষ্ট করে রাখে। আকাশে মেঘ না হলে এখান থেকেও দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা, সেই গল্প শুনতে শুনতে এসে পড়লাম জোড় বাংলো।
এখান থেকে ৪কিলোমিটার দাওয়াই পানি।আর নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সব মিলিয়ে ৭৬ কিলোমিটার । দার্জিলিং, কালিংপঙ বা শিলিগুড়ির দিক থেকে দাওয়াই পানি যেতে চাইলে, এই জোড় বাংলোয় আসতেই হবে। জোড় বাংলো একটা ছোট্ট পাহাড়ি গঞ্জ,কিছু দোকান পাট, এটিএম,ব্যাঙ্ক,পোস্ট অফিস,স্কুল নিয়ে জমজমাট।জোড় বাংলো থেকে ডান হাতে চড়াই রাস্তা ধরলো শ্যাম দাজু। সরু,নির্জন পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, দুই ধারে পাইন বার্চের সারি, সঙ্গে সূর্যের আলো আঁধারীর খেলা দেখতে দেখতে এসে পৌঁছালাম একটা কাঠের বাড়ির সামনে। শ্যাম দাজু বললো – উতরিয়ে,আ গায়া।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম বেশ ঠান্ডা, আর খুব হাওয়া বইছে। একজন প্রায় দৌড়ে আমাদের কাছে এসে বললো- সু -স্বাগতম। জানলাম, ইনিই বীরেন রাই,এই হোম স্ট্রর মালিক। রাস্তা থেকে দু চার পা উপরে হেঁটে উঠে দেখলাম , মুখোমুখি দুটো কাঠের বাড়ি। বাঁ দিকের বাড়িটার ঘরে ততক্ষণে আমাদের লাগেজ নামিয়ে রাখছে ,শ্যাম দাজু, বুঝলাম এটাই আমাদের থাকার জায়গা । সামনে একটা কাঠের বারান্দা টপকে বসার ঘর,আর তার সংলগ্ন দুটো বেড রুম। বারান্দা জুড়ে অনেক রঙ বেরঙের ফুলের গাছ। বেশ ভাল ব্যবস্থা , সবার খুব পছন্দ হয়েছে। অবাক হলাম,পাহাড়ের মাথায় এই একটাই বাড়ি, এর পরই রাস্তা নেমে গেছে নিচুর দিকে। আর সেই দিকেই বাড়ির উঠোন,তবে খোলা দিগন্ত প্রসারিত শূন্যতা,যা এখন কিছুটা মেঘে ঢেকে আছে।শুনলাম এখানেই আছে কাঞ্চন জঙ্ঘা, এখন মেঘের আড়ালে । এখানকার প্রথা মেনে সবাইকে খাদা পড়িয়ে বরন করা হল,তোলা হল এক সাথে ছবি। কাউকে কিছু বলার আগেই বেশ বড় বড় কাপে গরম ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে হাজির বাড়ির মালকিন সাবিত্রী ভাবী। মেয়ের জন্য গরম দুধও দিতে চাইলেন, কিন্তু মেয়ে রাজী নয় । বারান্দায় উল্টো দিকে যে বাড়িটা দেখেছিলাম, ওটা রান্নাঘর আর তার সঙ্গেই খাবার টেবিল পাতা। কাঠের উনুনে গরম জল হচ্ছে সব সময় ।
আমরা স্নান সেরে হাজির হলাম মধ্যাহ্ন ভোজে। গরম গরম ভাত,ডাল ,ভাজা, কোয়াশের তরকারি আর ডিমের কারি, শেষে জলপাইয়ের চাটনি। অপূর্ব সুস্বাদু খাবার, অনেকদিন বাদে এতটা ভাত খেলাম। বউ বললো এখানে কিছুদিন থাকলে তো মোটা হয়ে যাবো। খেয়ে উঠে আমরা ঘুরে দেখলাম আমাদের বাড়ি, একটা গোয়াল ঘরে দুটো গরু আছে,আছে বেশ কিছু দেশি মুরগি। বাড়ির পাশেই চাষ হয়েছে ভুট্টা, ধনেপাতা।
বিকেলে চা খেয়ে আমরা গ্রাম ঘুরতে বেড়োলাম। একটাই রাস্তা ধরে ছোট্ট এই জনপদ। সাকুল্যে ১০০ থেকে ১৫০ টা পরিবারের বাস। আমরা আছি নয়া বস্তিতে আর রাস্তার শেষ মাথায় পুরানা বস্তি । এর মধ্যেই দোকান,প্রাইমারি স্কুল, মন্দির। এখানে সবাই চাষবাস করে। ধাপ চাষ পদ্ধতিতে উৎপাদন হয় ভুট্টা, সর্ষে, বাঁধাকপি,আলু,ধনেপাতা, কোয়াশ, এলাচ। এছাড়াও মুরগি, পশুপালন হয় ঘরে ঘরেই। পুরানা বস্তিতেও কিছু হোম স্টের ব্যবস্থা আছে। ফেরার সময় হঠাৎ দেখলাম, বেশ কয়েকটা টর্চের আলো,কয়েক জনের মধ্যে ডাকাডাকি, ব্যস্ততা।জিগ্যেস করায় জানলাম, এক বয়স্ক মানুষ খুব অসুস্থ, তাকে এখনই কালিংপঙ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। মনে হল, বেঁচে থাকার জীবন শৈলী আলাদা হলেও, মানবতা সব জায়গায় একইরকম। আমরা ঘরের পথে ফিরছি, অন্ধকার হয়ে গেছে, রাস্তায় অনেক দুরে দুরে ডুমের আলো, ডান দিকের পাহাড় তখন সেজে উঠেছে। মনে হচ্ছে ওখানে বোধহয় আজ দেওয়ালি।জানলাম ওটাই দার্জিলিং ,আলোর মালায় সেজে উঠেছে পাহাড়ের রানী। চড়াই পথে আস্তে আস্তে ফিরছি, কিন্তু টের পাচ্ছি ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে বসছে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে দাওয়াই পানির উচ্চতা ৬৫০০ ফুট। ততক্ষণে বাড়িতে যে অন্য কিছু অপেক্ষা করছে কে ভেবেছে। ফিরে দেখলাম উঠোনে কাঠ সাজিয়ে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করছে সাবিত্রী ভাবী। এরই কোনও এক ফাঁকে বীরেনজীর সাথে কথা বলে ক্যাম্প ফায়ারের ব্যবস্থা পাকা করেছে কৌশিক। বললো দেশি মুরগি দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না।
দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন,আমাদের ওম পোয়ানোর সাথে সাথে তন্দুর হচ্ছে মুরগি। খুব হাওয়া বইছে , মেয়েকে কান মাথা ঢাকা টুপি পড়ানো হয়েছে।আগুনের ধারে বসে গান ধরেছে আমার বউ- আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…..
(চলবে)