আসল নাম এডওয়ার্ড টিচ কিংবা এডওয়ার্ড থ্যাচ।ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তখন খুব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বন্দর, যেখান থেকে দাস ব্যবসা চালানো হত। সেখানেই বেড়ে ওঠেন এডওয়ার্ড। বড় হয়ে এডওয়ার্ড ব্রিস্টল ছেড়ে চলে যান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের দিকে, যোগ দেন প্রাইভেটিয়ার হিসেবে। প্রাইভেটিয়ার হল যারা সমুদ্রের জাহাজ লুট করে। এডওয়ার্ড কাজ করতে লাগলেন জলদস্যু ক্যাপ্টেন বেঞ্জামিন হর্নিগোল্ডের অধীনে, জাহাজের নাম ছিল রেঞ্জার। চার বছর কাজ কবার পর তিনি পেলেন নিজের জাহাজ, ‘রিভেঞ্জ’। সেই জাহাজে ক্রু নিয়ে ক্যারোলাইনাস, ভার্জিনিয়া এবং ডেলাওয়ারে অন্য জাহাজ আক্রমণ করা শুরু করে দিলেন।এরপর এডওয়ার্ড এক ফ্রেঞ্চ জাহাজ দখল করেন। সেটার নাম ছিল ‘লা কনকরদ দে নান্তে’। তিনি সেটার নাম দিলেন “কুইন অ্যান’স রিভেঞ্জ”। এখনও পর্যন্ত সেই জাহাজ ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত জলদস্যু জাহাজ! এরপর এডওয়ার্ড লম্বা কালো দাড়ি রাখতে লাগলেন, সেই থেকেই তার নাম হলো ব্ল্যাকবিয়ার্ড।
সেই সময় জলদস্যুরা জলি-রজার পতাকা ব্যবহার করত, যেখানে থাকত খুলি আর হাড়ের ছবি। কিন্তু ব্ল্যাকবিয়ার্ড বেছে নিলেন ইউনিক এক পতাকা, তার নিজের পতাকা। সেখানে কংকালের ছবির পাশাপাশি ছিল শয়তানের ছবি যে কিনা এক হাতে মদের পাত্র ধরে রেখেছে আর অন্য হাত রক্তঝরা হৃদপিণ্ডের দিকে মুখ করা বর্শা। এর মানে ছিল- তার শত্রুরা যদি আত্মসমর্পণ না করে, তবে সবাই মরবে। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের দল পুরো ক্যারিবিয়ান জুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। শহরের পর শহর পুড়িয়ে দেয় তারা। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের প্রথম বড় যুদ্ধ ছিল সেন্ট ভিন্সেন্ট উপকূলে ইংলিশ জাহাজ ‘গ্রেট অ্যালেন’-এর সঙ্গে। সেই যুদ্ধে ব্ল্যাকবিয়ার্ড জাহাজ দখল করে লুটপাট চালিয়ে জাহাজটা ডুবিয়ে দিয়েছিলেন।
এর কিছুদিন পর ব্ল্যাকবিয়ার্ডের বাহিনী সেইন্ট থমাস দ্বীপের কাছে ব্রিটিশ রয়াল নেভির দানবীয় জাহাজ এইচএমএস সীফোর্ড-এর দেখা পেয়ে তাদের সামনে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজে ব্রিটিশ পতাকা উড়িয়ে দেয় যাতে কেউ সন্দেহ না করে। ফলে ব্রিটিশরা বুঝতে পারে নি যে সেটা কুখ্যাত ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজ। পরের কয়েক মাস ব্ল্যাকবিয়ার্ড উত্তর আমেরিকার উপকূল আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ জুড়ে গোটা চল্লিশেক জাহাজ লুট করে। যেসব জাহাজ আত্মসমর্পণ করত, ব্ল্যাকবিয়ার্ড তার ক্রুদের ছেড়ে দিতেন, কিন্তু বাধা দিলেই জাহাজসহ তাদের পুড়িয়ে ফেলতেন। এরপর ব্ল্যাকবিয়ার্ড তিনটি বড় জাহাজ নিয়ে কিউবা আর ফ্লোরিডার উপকূল চষে বেড়াতে লাগলেন।
এরপর ব্ল্যাকবিয়ার্ড সাউথ ক্যারোলাইনার চার্লস্টন অবরোধ করেন। তখন তার দাবি ছিল ওষুধ। ওষুধ আনতে তিনি তাঁর প্রতিনিধিদের পাঠালেন, কিন্তু ওষুধ নিয়ে ফিরতে তাদের বহু দেরি হয়ে যাওয়ায় তিনি তাদের প্রায় খুন করেই ফেলেছিলেন, যখন শেষ মুহূর্তে ওষুধ এসে হাজির হয় তখন ওষুধ নিয়ে তিনি তাদের ছেড়ে দিয়েছিলেন।একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ব্ল্যাকবিয়ার্ড নিজের জাহাজ আর ক্রুদের নিজেই ধ্বংস করতেন। এমনকি কুইন অ্যান’স রিভেঞ্জসহ তিনটি জাহাজ তিনি নিজেই ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। অবশেষে নর্থ ক্যারোলাইনাতে এসে ব্ল্যাকবিয়ার্ড সেখানকার গভর্নরের উপস্থিতিতে ১৪তম বিবাহ করেন, যদিও তখন তাঁর ১২ জন স্ত্রী জীবিত।
কিছুকাল শান্ত থাকার পর ব্ল্যাকবিয়ার্ড আবার নিজের জাহাজ “অ্যাডভেঞ্চার” নিয়ে সমুদ্র জুড়ে লুট করতে লাগলেন। একটা সময়ে ব্ল্যাকবিয়ার্ড তাঁর চুলের গোড়ায় ধীরে ধীরে নেভা আগুন জ্বালিয়ে দিতেন, তাঁকে দেখে মনে হত তাঁর মাথায় যেন আগুন জ্বলছে- শত্রুরা সেটা দেখে ভড়কে যেত।ভার্জিনিয়ার গভর্নর অ্যালেক্সান্ডার স্পটসউড তাঁর মাথার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু লেফটেন্যান্ট রবার্ট মেয়নার্ড-এর নেতৃত্বে এক নাটকীয় ব্ল্যাকবিয়ার্ডের বাহিনী পরাস্ত হয়। ব্ল্যাকবিয়ার্ডের লাশ পরীক্ষা করে দেখা গেল তার দেহে পাঁচটি গুলি আর বহু তরবারির আঘাত। তাঁর লাশ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলা হয় এবং জাহাজের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়। আর দেহটা ফেলে দেওয়া হয় সাগরে। গুজব আছে, তার মাথাকাটা লাশ মেয়নার্ডের জাহাজের চারদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করে, এরপর ডুবে যায়। তারপর থেকে ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে নিয়ে ক্যারিবীয় নাবিকদের মধ্যে হাজার কুসংস্কার চালু হয়ে যায়।
গত শতকের শেষে নর্থ ক্যারোলাইনার আটলান্টিক বিচের কাছে গভীর সমুদ্র থেকে ব্ল্যাকবিয়ার্ডের জাহাজ কুইন অ্যান’স রিভেঞ্জ-এর ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার হয়। তবে তখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি এটিই সেই জাহাজ কিনা। নিশ্চিত হওয়া যায় ২০১১ সালে।ব্ল্যাকবিয়ার্ডকে নিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে, সিনেমা হয়েছে। রবার্ট লুই স্টিভেনসনের “ট্রেজার আইল্যান্ড”-এও ব্ল্যাকবিয়ার্ডের নাম পাওয়া যায়। পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ান আর অ্যাসাসিন্স ক্রিড-এর কথা তো আছেই। তবে যে গুপ্তধন ব্ল্যাকবিয়ার্ড লুকিয়ে রেখে গেছেন, সেগুলোর খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি। হয়ত কোনো একদিন খোঁজ মিলবে।