তীর্থঙ্কর
১৯৪০ সালে কাতারের ‘দুকান’ অঞ্চলে, উচ্চমানের ভূগর্ভস্থ তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে খনিজ তেলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং তেল থেকে সংগৃহীত রাজস্বের কল্যাণে, কাতারের বৈভব বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। একই সাথে বৈদেশিক অভিবাসন শুরু হয়ে যায় এবং জীবনযাত্রার মানও উৎকর্ষ লাভ করে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে, ব্রিটেন যখন পারস্য উপসাগরীয় অন্যান্য দেশগুলোর সাথে পুরোনো সুরক্ষাচুক্তির ইতি টানে, কাতার উপসাগরীয় বাকি আটটি দেশের সাথে যুক্ত হয়ে ‘ফেডারেশন অফ আরব এমিরেটস’ এর অঙ্গ হয়ে যায়। ১৯৭১ সালে, ব্রিটেনের সাথে কাতারের সুরক্ষাচুক্তির মেয়াদ শেষ হয় এবং ‘ইউনাইটেড আরব এমিরেটস’ এর অন্যান্য আটটি দেশের সাথে ইউনিয়নের শর্তাবলী নিয়ে মতানৈক্য হয়। তখন, ১৯৭১ এর ৩ রা সেপ্টেম্বর, কাতার একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
কাতার দেশটি আমির শাসিত একটি সুন্নি মুসলমান দেশ। তবে, মূল অধিবাসীদের কিয়দাংশ সিয়া সম্প্রদায়েরও অনুগামী। মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশ হলেও, কাতার সৌদি আরবের মতো কট্টর ধর্মান্ধতায় বিশ্বাসী নয়। কাতারিরা লৌকিকতায়, অনেক বেশি উদার মনোভাবাপন্ন। কাতারের বর্তমান আমিরের নাম, শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি। ইনি শিক্ষা এবং ক্রীড়ার প্রসারে, বিশেষ সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। শেখ তামিমের তিনজন রানী এবং চব্বিশটি সন্তান। বহুবিবাহ প্রথাটি কাতারিদের স্বাভাবিক জীবনশৈলীর একটি অংশ।
কাতারের রাজধানীর নাম দোহা। এছাড়া, উম্ম সাঈদ হলো মুখ্য বন্দর এবং শিল্প শহর। কাতারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরের নাম আল – রায়ান। অন্যান্য শহরগুলির মধ্যে আবু হামর, আবু সামরা, এইন খালেদ, বনি হাজের ইত্যাদির নাম করা যেতে পারে। আল খোর, আল ওয়াকরা, মেসাইদ, আল যুবারা, আল সামাল, খাওর আল উদাঈদ – ইত্যাদি গ্রামেও অনেক মানুষ বসবাস করেন।
আধুনিক মানের জীবনযাত্রা, যেমন মাল্টিপ্লেক্স, মাল্টি কুইজিন রেস্তোরাঁ, মল কালচার – এসব কাতারের যাপন ধারার অঙ্গ হয়ে গেছে।ফেস্টিভ্যাল সিটি, মল অফ কাতার, ভিলাজিও, সিটি সেন্টার, লগোনা মল, এজদান মল, আল খোর মল, গাল্ফ মল, ল্যান্ডমার্ক মল – এইসব মলগুলো কাতারিদের উন্নত জীবনযাত্রা এবং পরিমার্জিত রুচিরই পরিচয় বহন করছে।
শিক্ষার মানের ব্যাপারেও, কাতার যথেষ্ট উন্নত। এখানে অনেক আন্তর্জাতিক বিদ্যালয় এবং প্রাযুক্তিক শিক্ষাকেন্দ্র আছে। নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে বলা যায় – এ দেশে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জনসাধারণই, দেশের সমস্ত রকমের সরকারি এবং বেসরকারি দফতর, ফ্যাক্টরি, বিজনেস ফার্ম এবং হাসপাতাল, শপিং মল – সর্বত্র কাজ করে। এঁদের মধ্যে অনেক মহিলাও আছেন। তাঁরা, তাঁদের নিজেদের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরিচ্ছদই পরে থাকেন। ফিলিপিনো, চাইনিজ বা ভারতীয় মহিলারা জিন্স এবং টপ বা টিশার্ট পরেও কাজে যান বা রাস্তাঘাটে বের হন। আবার অন্যান্য রক্ষণশীল মুসলিম দেশের মহিলারা বোরখা পরে কাজে যান। এদেশে নারীদের পোশাকের ব্যাপারে এবং নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে কোনো কট্টর অলিখিত আইন নেই। তবে, যাঁরা মূল কাতারি, সেই সব পুরুষ এবং মহিলারা প্রথাগত পোশাক পরতেই অভ্যস্ত। নিজেদের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির ঐতিহ্য রক্ষা করতে এঁরা যথেষ্ট গর্ব বোধ করেন।
কাতারি পুরুষরা ঢিলা পায়জামার ওপর, পা পর্যন্ত আলখাল্লার মতো বিস্তৃত সাদা রঙের একধরণের শার্ট পরেন। এই শার্টগুলোকে ‘থোব’ বলা হয়। এঁরা নিজেদের মাথা, সবসময় সাদা অথবা সাদার ওপর লাল রঙের নকশা করা একপ্রকার ওড়না জাতীয় কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। এই ধরণের পাগড়িকে ‘গুতার’ বলা হয়। এই গুতারকে মাথার সঙ্গে, একধরণের কালো রঙের দঁড়ি দিয়ে আটকে রাখা হয়, যাতে মরুভূমির তীব্র হাওয়ায় উড়ে না যায়। সেই দঁড়িগুলোকে বলা হয় ‘আগল’।
কাতারি মহিলারা সাধারণত সালোয়ার কামিজ জাতীয় বস্ত্রের ওপর, পা পর্যন্ত বিস্তৃত কালো রঙের একটি ক্লোক জাতীয় পোশাক পরেন, যাকে ‘আবায়া’ বলা হয়। এঁরাও নিজেদের মাথা, সবসময় কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন এবং বাড়ির বাইরে বের হলে, কালো রঙের ‘হিজাব’ বা ‘বোরখা’ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন।
আগেই বলেছি, কাতার উপদ্বীপটি আয়তনে আমাদের অবিভক্ত চব্বিশ পরগনা জেলার থেকেও ছোট। তা এহেন একটি দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য থানা পুলিশের সংখ্যাও অনেক কম হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কাতারে মুখ্য থানা বা পুলিশ স্টেশনের সংখ্যা মাত্র দশটি। এছাড়া কিছু কিছু ছোট চেক পোস্ট এবং মোবাইল চেক পোস্ট এর ব্যবস্থা আছে। আসলে, ইসলামিক রাষ্ট্র বলে এ দেশে ক্রাইম একেবারেই নেই বলা চলে। যদিও দেখিনি, তবে শুনেছি শরিয়া আইনে চুরি করার শাস্তি – হাত কেটে দেয়া, খুন করার শাস্তি – প্রকাশ্যে গুলি করে মারা এবং ধর্ষণের শাস্তি – গুপ্তাঙ্গচ্ছেদন। হয়তো, এইসব আইনের ভয়েই এদেশে চুরি, ধর্ষণ, খুন কোনো কিছুই হতে দেখিনি বিগত সাড়ে তিন বছরে। তাহলে, পুলিশের ভূমিকাটা কি এই দেশে? পুলিশ কি বসে বসে মাইনে নেয়? পুলিশ সাধারণত – পথ দুর্ঘটনা, অগ্নিকান্ড, ট্রাফিক আইন উল্লঙ্ঘণ, সার্বজনীন জনবহুল জায়গাগুলোতে মানুষের শৃঙ্খলা – এইসব ব্যাপারগুলোকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এদেশের পুলিশের গুপ্তচর বা ‘সি আই ডি পুলিশের’ও খুব সুনাম আছে। হয়তো এটাও একটা কারণ, কাতারে কোনো প্রকার অপরাধ না হওয়ার।
এখানকার বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে যতটা জানতে পেরেছি, দুই ধরণের আদালত আছে। প্রথমটা ‘ক্রিমিনাল কোর্ট’, যেখানে সমস্ত রকমের দেওয়ানি এবং ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি করা হয়। আর দ্বিতীয় প্রকারের আদালতটিকে ‘রিলিজিয়াস কোর্ট’ বলা হয়। এখানে, ধর্মীয় তাত্তিক বিচার বিশ্লেষণে যারা অপরাধী, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে মামলা এবং বিচার চলে। তবে, বহিরাগত বিদেশীদের, এই দ্বিতীয় ধরণের আদালতটির আওতার বাইরে রাখা হয়।
শেষ…