তিনি নিজে ছিলেন দর্শনের ছাত্র। পাশাপাশি মার্শাল আর্টের চর্চাও করতেন। মার্শাল আর্টের মধ্যেও যে এক ধরণের দর্শন আছে; মার্শাল আর্টের নিজস্ব চর্চা দিয়েতিনি সেটা পাশ্চাত্যের সামনে হাজির করেন। কিন্তু সারা বিশ্ব তাঁকে চিনেছিল কুংফু মাষ্টার বলে। আসলে তিনি বিভিন্ন ধরনার মার্শাল আর্টের সারাংশ নিয়ে তৈরি করেছিলেন নিজস্ব স্টাইল– জিত কুনে ডো।
জন্মেছিলেন সান ফ্রান্সিসকোতে। যখন মাত্র এক বছর বয়স, তখন তাঁর পরিবার চলে আসে হংকং-এ। তাঁর বাবা লি হুই চোয়েন ছিলেন একজন পেশাদার নাট্যশিল্পী। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটি ছিল মারকুটে। সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে মারামারি করার জন্য একটি দল তৈরি করেছিলেন। কিন্তু হালকা পাতলা চেহাড়ার ছেলেটি সবসময় যে মারাামারিতে জিততে পারতেন তেমনটাও নয়। তাই প্রতিপক্ষকে যাতে হারাতে পারেন তার জন্য মার্শাল আর্ট শেখা শুরু করেন।
ছেলেবেলায় মার্শাল আর্টের পাশাপাশি তাঁর অভিনয়ে আগ্রহ জন্মায় বাবার সঙ্গে স্টুডিওতে গিয়ে অভিনয় দেখে। যখন তাঁর ছ’বছর বয়স তখন তিনি প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পেলেন ‘দ্য বিগিনিং অফ অ্যা বয়’ ছবিতে। হংকং-এর সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার স্কুলে পড়ার সময় তিনি কুংফুর পাশাপাশি চীনাদের আত্মরক্ষার কৌশল উইং-চানও শেখাও শুরু করেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেইতাঁর স্বভাবে ঔধ্যত্ব লক্ষ্য করা যেত। এক শিক্ষক তাঁর আচরণে ঔধ্যত্ব ভাব দেখে তাঁকে শাস্তি দেওয়ার জন্য স্কুলের বক্সিং রুমে নিয়ে যান এবং তাঁরসঙ্গে বক্সিং লড়তে বলেন। এর আগে তিনি কোনোদিনও বক্সিং শেখেননি কিন্তু উইং চান-এর কৌশল জানা থাকায় খুব সহজেই অভিজ্ঞ প্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষককে তিনি বক্সিঙে পরাস্ত করেন। তাঁরকৌশল দেখে খুশি হয়ে শিক্ষক তাঁকে বক্সিং টিমে নেন। সেই বছর তিনি জীবনের প্রথম টুর্নামেন্টে স্কুলের একটানা তিন বছরের বক্সিং চ্যাম্পিয়নকে হারিয়ে দেন।
মার্শাল আর্টের পাশাপাশি ল্যাটিন আমেরিকার নাচ ‘চা-চা’ ছিল তাঁরখুব প্রিয়। সেই নাচে তিনি হংকং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বহু পুরস্কারও পেয়েছিলেন ‘চা-চা’ নাচের প্রতিযোগিতায়। অবসরে তিনি ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। তাছাড়া কবিতাও লিখতেন! তাঁর কবিতা সংকলিত হয়েছে “The Tao Of JeetKune Do”– বইটিতে। দর্শনেরএই ছাত্রটি মার্শাল আর্টের পাশাপাশি নানান বই পড়তেও ভালবাসতেন।তাঁর নিজের সংগ্রহ করা প্রায় দু’হাজার বইয়ের একটি লাইব্রেরিও ছিল। দর্শনের নানা প্রসঙ্গে আগ্রহ থাকলেও কিন্তু তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না!
তবে তাঁর সব থেকে বেশি ইচ্ছা ছিল সিনেমার হিরো হওয়ার। মার্শাল আর্টের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে তাঁর নাম-ডাক ছড়িয়ে পড়লেও সিনেমায় তেমন সাফল্য পাচ্ছিলেন না। ইচ্ছে ছিল কুংফু নামে একটি টিভি সিরিয়ালে নায়ক হওয়ার। সম্ভবত উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে সাত ইঞ্চি হওয়াতে তাঁরজায়গায় সেই চরিত্রের জন্য অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান ডেভিড ক্যারাডিন। তাঁর উচ্চতা ছিল ছ’ফুটেরও বেশি। তিনি তখন ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এশিয়ান বলে হলিউডের ছবিতে তিনি সুযোগ পাচ্ছেন না। এরপর স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি সপরিবারে চলে আসেন হংকং। সেখানে প্রযোজক রেমন্ড চো‘র সঙ্গে জুটি গড়ে তোলেন। তাঁকে নিয়ে রেমন্ড ‘দ্য বিগ বস’ নামে একটি কুংফু ছবি তৈরি করেন।
হংকং এর দর্শক বিভিন্ন কুংফুর ছবি দেখে অভ্যস্ত। তাই আলাদা কিছু দেখাতে না পারলে তাদের খুশি করা সম্ভব নয়। দেখা গেল পর্দায় তাঁর দুর্দান্ত ফ্লাইং কিক আর ঘুষি দেখে দারুণ মুগ্ধ দর্শকেরা। ‘দ্য বিগ বস’-এর পরতাঁর ‘দ্য চাইনিজ কানেকশান’এবং ‘রিটার্ন অফ দ্য ড্রাগন’ বক্স অফিসে হিট করে। বলার অপেক্ষা রাখে না আমরা এতক্ষণ কথা বলছি যাকে নিয়ে তিনি ব্রুস লি।
অভিনেতা হিসেবে হংকং সিনেমায় শুরু আর শেষ হলিউডে। খুব বেশি নয়, কিন্তু সেটুকুই কিংবদন্তি হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট ছিল।তাঁর অকাল মৃত্যুর কিছুদিন পরে হলিউডে তাঁর সব থেকে জনপ্রিয় সিনেমা ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’ মুক্তি পায়। তারপর সবটাই ইতিহাস। ব্রুস লির আগে হলিউডের অ্যাকশন সিনেমা বলতে গ্রেগরি পেক, ওমর শরিফ, স্টিভ ম্যাকুইনদের ঘোড়া ছোটানো আর গান ফাইট। ঘোড়া বা বন্দুক ছাড়াও যে অ্যাকশন দেখানো যায়, সেটা হলিউড শেখে ব্রুসের কাছেই। আসলে ‘এন্টার দ্য ড্রাগন’-এর বিশেষত্ব একমাত্র অ্যাকশন দৃশ্য। কিন্তু প্রতিটি স্টান্ট ব্রুসলির নিজের করা। কোনও একটা দৃশ্য পাওয়া যাবে না যেখানে অবাস্তব মুভমেন্ট আছে। না আছে ক্যামেরার কারসাজিবা কম্পিউটার গ্রাফিক্স। একটি মাত্র লোক অজস্র শত্রুকে মারছে কিন্তু সেটা তাঁর নিজস্ব কৌশল এবং ক্ষমতায়।
হলিউডে সেই সময়ে ব্রুশ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে স্টিভ ম্যাকুইনের মতো অভিনেতাও মার্শাল আর্ট শেখার জন্য তাঁর ছাত্র হয়ে যান।