দুই
‘হাসপাতাল থেকে ফিরবো। একটু দেরি হবে।’ ওপ্রান্তের উত্তর শোনার আগেই ফোনটা কেটে দেয় ভ্রমর। এরকমই সে। পায়ের তলা, হাতের তালু এবং অধর রক্তিম। কণ্ঠস্বর হাঁসের মতো মধুর। ঘন কেশ, গায়ের রং শ্যামলা। চোখের পাতাগুলি বঙ্কিম, ঠোঁট দুটি বিম্বফলের মতো, কটিদেশ ক্ষীণ, গ্রীবাদেশ শঙ্খের মতো তিন রেখায় অঙ্কিত, মুখখানি নিটোল। নির্মাণে বিনির্মাণে প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্না, ব্যক্তিত্বসম্পন্না, যুক্তিনিষ্ঠ, অন্যায়ের প্রতিবিধানে সদা সতর্ক, বিচক্ষণ। ভ্রমর হাসপাতাল থেকে যখন বেরিয়ে এল ক্লান্ত বিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় তখন কনে দেখা আলোয় ভরে আছে চারদিক। রাস্তায় জ্যাম। হর্ণের কর্কস শব্দ, পোড়া ডিজেলের গন্ধ। রাস্তার দিকে তাকিয়ে চোখমুখ কুঁচকে ওঠে ভ্রমরের। ওর বিরক্তি চরমে উঠেছে। এই হতশ্রী শহরটাকে অবিলম্বে পরিত্যক্ত ঘোষনা করা হলে ভালো হয়; কিন্তু নতুন শহরে যে যেতে চায় না তার ভালোবাসা। ভ্রমর ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই একটা ফুলের দোকান। রজনীগন্ধার আর গাদা ফুলের কড়া গন্ধ বাতাসে ভাসছিল। আকাশে কনে—দেখা—আলোয় কেমন যেন চুপ করিয়ে দেয় ভ্রমরকে। সে ভাবে, ‘মেয়ে’ মানেই একটা রঙিন ফ্যান্টাসি, নরম পুতুলের মতো তার উপস্থিতি। যাকে সব ত্রুটি ঢেকে অন্যের চোখে সুন্দর হয়ে উঠতে হয় এবং নিশ্চিতভাবেই তখন তার সঙ্গে জুড়ে যায় বিয়ের অনুষঙ্গ। ‘কনেবউ’ কে ঠিক কোন আলোর নিচে দেখলে মনে হয় সে অপার্থিব রূপসী, অন্যের আকাঙ্ক্ষার পাত্রী, তা-ই যেন তার যে কোনও অভিব্যক্তির একমাত্র সার্থকতা। তার গুণ বা স্বাধীনতার ইচ্ছা, কিংবা এই সৃষ্টিকে উপলব্ধির ক্ষমতা সেসব শুধু তার একার জানার জন্য, এক নিঃসঙ্গতার গল্প।
নিজের সমস্ত ‘ত্রুটি’ ঢেকে ফেলে অন্যের কাম্য হয়ে ওঠার স্বাভাবিক অদম্য আকর্ষণ মাথাতেই নেয় না ভ্রমর। নিজের রক্তমাংসের ‘আসল’ মেয়েটিকে লুকিয়ে রাখতে চায় না সে। কারণ, ভ্রমর জানে এই লুকিয়ে পড়াটা চলতেই থাকে সারাজীবন। আর একসময় মেয়েটিও ভুলে যায় আয়নার সামনে তার অন্য কাউকে দেখার কথা ছিল। অপরের মুগ্ধতার প্রতিফলনে নয়, বরং নিজের সমস্ত ত্রুটিকে ‘ওন’ করে তার নিজস্ব আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে সে। তার চিবুক, ঠোঁটের পাশের ভাঁজ, নাক, কপাল, মুদ্রাদোষ, ব্রণর দাগ, কাঠকাঠ কবজি, লালচে ফরসা বা আষাঢ়ের মেঘের মতো রং এই সবকিছু বাড়িয়ে-কমিয়ে একটা সুষম, সুন্দর সিম্ফনি তৈরিতে তার কোনও আগ্রহ নেই। তাই রাস্তার ওপাশে সারসার বিউটি ট্রিটমেন্ট, স্কিন টাইটেনিং, ফেসিয়াল-স্পা-ম্যানিকিওর-পেডিকিওর বিজ্ঞাপন হাঁ করে দেখে ভ্রমর। তাকে ঘিরে থাকে সেই নিষ্পাপ কনে দেখা আলো। বারবার তার নিটোল নারীত্বের প্রেমে পড়তে বাধ্য থাকে যে কোনও পুরুষ। এবং যে-সে প্রেম নয়, ‘একদম বিয়েই করে ফেলতে হবে’ জাতীয় প্রেম!
ভ্রমর জানে সব রূপকথার গল্পই যেভাবে শেষ হয়, সেভাবেই বিয়েটাও হয়ে যায়। তারপর যে রক্তমাংসের মানুষটা পড়ে থাকে তাকে নিয়ে আর কেউ গল্প লেখে না, মুগ্ধতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে না। বিয়ে যেন কোনও মেয়ের ‘পরিচিতি’-র ক্ষেত্রে একটা বিফোর-আফটার প্রাচীর। দুটোই আসলে একই বিস্মৃতির দুটো আলাদা রূপ। বিয়ের তলায় হারিয়ে যাবে তার নিজের মুখ, স্বপ্ন দেখার দুঃসাহস। তবে যদি মৃত্যুর পর তার নামে কেউ বানিয়ে দেয় মুমতাজ-মহল, তবেই ইতিহাস মেয়েটিকে মনে রাখবে। কিন্তু সন্তর্পণে এড়িয়ে যাবে তার মানবী—জীবন, বলবে না তার মৃত্যু হয়েছিল বিয়ের দিনই। আমাদের চেতনে বা অবচেতনে, বিয়ে তাই কোনও মেয়ের জীবনের একটা ডিফাইনিং ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। এসব কথা ভাবলেই কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে ভ্রমরের। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় ফলের দোকানের দিকে। গোটা পাঁচেক অমর ফল পড়ে আছে আপেলের ডালার ঠিক পাশে। চারশো টাকা কেজি। ভ্রমর কিনে নেয় সবক’টি। শোনা কথা, হনুমান অনেক খুঁজে পেতে সীতার জন্য এই ফল এনেছিল। তবে গুগুল বাবাজি অন্য কথা বলছে। সংযুক্ত চায়নার প্রথম বাদশা ছিলেন কিন সি উয়াঙ। অতীতে চায়না ছোট অংশে বিভক্ত ছিল এবং তিনি প্রথম এই ছয়টি অংশকে একত্র করে রাজত্ব শুরু করেন। কিন সি উয়াঙ এর কাছে বিপুল পরিমাণে ধন-সম্পদ এবং ক্ষমতা থাকলেও তিনি অমরত্বের আশায় ব্যাকুল ছিলেন। মৃত্যুর দুশ্চিন্তা তাকে গ্রাস করেছিল। আর সেই থেকেই শুরু হয় তার অমরত্ব লাভের খোঁজ। প্রাচীন চীনের কিছু পন্ডিতের কাছ থেকে তিনি জানতে পেরেছিলেন এক দুর্লভ ফলের কথা যা খেলে মৃত্যু কোনদিন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এই খবর শুনে তিনি তাঁর খুব কাছের এবং নবীর বেশ কয়েকজন সৈন্যকে ওই ফলের সন্ধানে পাঠান কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল ওই ফলের সন্ধানে যাওয়া কোন ব্যক্তি আর ফিরে আসেনি কোনও দিন। ভ্রমরের শখ এই ফল অন্তত একবার সে তার ভালোবাসাকে খাওয়াবে। দ্রুত বাড়ি ফিরে আসে ভ্রমর। কান্নায় ভেঙে পড়ে ভালোবাসার কাছে। বলে, সেকি খুব খারাপ এই সমাজের কাছে। ভ্রমরের ভালোবাসা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, কনে—দেখা—আলো আসলে শুধু মেয়েটির নিজের ভাললাগার জন্য। যা মেয়েটির নিজের কাছে তার সমস্ত শারীরিক বা চারিত্রিক ত্রুটি ঢেকে দেয় ,আর সে আরও একবার নিজের প্রেমে পড়ে, বিয়ে বা না-বিয়ের বাইনারি ছাড়াই…