চারুচন্দ্র চক্রবর্তীকে আর ক’জন চেনেন-জানেন? কিন্তু যদি বলা হয় জরাসন্ধ, তাহলে অনেক সহজেই চেনা জানা যায়। আসলে চারুচন্দ্রই জরাসন্ধ ছদ্মনামে লিখতেন। তাঁর স্মরণীয় সৃষ্টি ‘লৌহকপাট’। উপন্যাসটিতে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে এক তরুণ চাকরির সন্ধানে ঘুরছে।শেষপর্যন্ত যে কাজটি পেলেন, সেটি হল কারা বিভাগে। ছোটখাটো একটি জেলের ডেপুটি জেলারের পদ। সম্পূর্ণ একটা নতুন জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটল সেখানে।
আলাপ হল মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব আসামী কাশিম ফকিরের সঙ্গে। কাশিম ফকির নাকি টাকা ডবল করে দিতে পারে। সেই লোভে লোকে তার নির্জন কুঠিতে যেত। কাশিম আর তার যুবতী বিবি কুটী টাকাটা নিয়ে তাদের বিষ মাখানো খাবার দিত। তারপর মৃতদেহটি টিলার ধারে গর্ত খুঁড়ে কবর দিত। একদিন এল এক স্বাস্থ্যবান যুবক। মুগ্ধ হল সে কাশিম ফকিরের সুন্দরী বিবির সৌন্দর্যে। কুটীবিবিরও মনে লাগল দোলা। একে মেরো না, বলল সে কাশিম ফকিরকে। কাশিমের রোখ চেপে গেল। কুটীকে না জানিয়ে গভীর রাত্রে বিষ খাইয়ে মারল সেই যুবককে। সকালে উঠে জানতে পেরে কুটীই ধরিয়ে দিল কাশিম ফকিরকে।
তারপর চাকরি সূত্রে বদলি হতে হয়েছে নানান জেলে। জেল-জীবনকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন খুব কাছ থেকে। কয়েদিদের কাছে শুনেছেন তাদের কাহিনী। সহকর্মীরাও শুনিয়েছেন নানা বিচিত্র ঘটনা।। সেইসব খণ্ড-কাহিনী সুনিপুণ ভাবে জোড়া দিয়ে লেখা হয়েছে ‘লৌহকপাট’। ‘লৌহকপাটে’র অবতরণিকাতে জরাসন্ধ লিখেছেন, ‘জীবনে এমন একটা পথে চলতে হয়েছে, যেটা প্রকাশ্য রাজপথ নয়। সে এক নিষিদ্ধ জগত। সেখানে যাদের বাস, তাদের ও আমাদের এই দৃশ্যমান জগতে দাঁড়িয়ে আছে লৌহদণ্ডের যবনিকা। তার ওপরে পাষাণ-ঘেরা রহস্যলোক। কিন্তু তারাও মানুষ। তাদেরও আছে বৈচিত্র্যময় জীবনকাহিনী – সুখে সমুজ্জ্বল, দুঃখে পরিম্লান, হিংসায় ভয়ঙ্কর, প্রেমে জ্যোতির্ময়! সেই পাষাণ পুরীর দীর্ঘ প্রকোষ্ঠের স্তব্ধì বাতাসে জমে আছে অলিখিত ইতিহাস, সভ্য পৃথিবী তার কতটুকু জানে? আমি যে সেখানে বিচরণ করেছি, এই দীর্ঘ জীবন ধরে, প্রভাতে. সন্ধ্যায়, নিভৃত রাত্রির অন্ধকারে – আমিই বা কতটুকে দেখেছি, কতখানিই বা শুনেছি। আহরণ যা করেছি, তোলা আছে স্মৃতির মণিকোঠায়। এখানে যেটুকু দিলাম, সে শুধু আভাস কিংবা তার ব্যর্থ প্রয়াস।’
কারাজীবন নিয়ে এর আগেও অনেক ভালো বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে, সাহিত্য-গুণে সেগুলিও উজ্জ্বল। কিন্তু তাদের লেখকরা ছিলেন প্রধানত: রাজনৈতিক বন্দী। তাঁদের লেখায় যে কারাজীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে- সেটা কারাজীবনের একটা দিক। ‘লৌহকপাট’ সেদিক থেকে স্বতন্ত্র। এর লেখক কারা-শাসনের সঙ্গে যুক্ত, তাই এর পটভূমি অনেক বিস্তৃত। লেখক কারাজীবনকে দেখেছেন পরম ঔৎসুক্য ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। কিন্তু জীবনকে জানলেও তার কাহিনী শোনানো সব সময়ে সহজ হয় না। তার ওপর সরকারী দপ্তরখানার অনেক বাধানিষেধ থাকে। লেখকের নিজের কথায়, “অনেক মুখরোচক তথ্যের স্বাদ থেকে পাঠককে বঞ্চিত করেছি।” তা হয়ত করেছেন, কিন্তু ওঁর প্রসাদগুণে পাঠকদের রস-তৃপ্তির বিশেষ ব্যাঘাত ঘটে নি।
জরাসন্ধ ছদ্মনামের আড়ালে মানুষটি হলেন অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করে দার্জিলিং-এ ডেপুটি জেলার হিসেবে কর্মজীবন সুরু করেন। তিরিশ বছর নানা জায়গায় কাজ করার পর ১৯৬০ সালে আলিপুর সেণ্ট্রাল জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। চারখণ্ডের ‘লৌহকপাটে’র তিনটি খণ্ডই ওঁর চাকুরিজীবনে লেখা। চতুর্থ খণ্ডটি লেখেন অবসর নেওয়ার পরে এবং কারও কারও মতে সেটিই সর্বশ্রেষ্ঠ খণ্ড। ‘লৌহকপাট’ ছাড়াও আরও প্রায় কুড়িটি উপন্যাস উনি লিখেছেন, ‘তামসী’, ‘পাড়ি’, ‘মসীরেখা’, ‘ন্যায়দণ্ড’, ‘উত্তরাধিকার’, প্রভৃতি। ওঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা হল ‘নিঃসঙ্গ পথিক’। এছাড়া ছোটগল্প এবং ছোটদের জন্য লেখা গল্পও ওঁর বেশ কিছু আছে।
‘লৌহকপাট’ সম্পর্কে একটা খবর হয়তো কিছু কিছু পাঠকের জানা নেই। দেশ পত্রিকার এককালের সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁর ‘হীরের নাকছাবি’ বইয়ে এটির উল্লেখ করেছেন। সাগরময় ঘোষের স্কুলের এক বন্ধু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তার একটি পাণ্ডুলিপি এক সময়ে দেশ পত্রিকার অফিসে এসে জমা দিয়ে যান, এক্সারসাইজ বুক নাম ‘লৌহযবনিকা’, লেখক ‘বিশ্ববন্ধì’। লেখা বা লেখকের নাম কোনটাই সাগরময়বাবুর কৌতূহল জাগায় নি, পাণ্ডুলিপিটিকে তিনি ড্রয়ারে চালান করেন। এর চার-পাঁচ মাস বাদে বন্ধুর একটা চিঠি পান। একটু কাতরভাবেই বন্ধু লিখেছেন যে, যদি লেখাটা ছাপার অযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেটা যেন রেজিস্ট্রি করে ওঁর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে লেখাটার কথা সাগরময়বাবু বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। বন্ধুর চিঠি পেয়ে একটু লজ্জিত হয়েই খাতা খুঁজে পেতে বার করলেন। ফেরত পাঠানোর আগে দুয়েকপাতা পড়তে গিয়ে কখন এক ঘণ্টা সময় কেটে গেছে খেয়ালও হয় নি। খাতাটা সেদিন বাড়ি নিয়ে রাত একটা পর্যন্ত পড়ে শেষ করলেন। তার পনেরো দিন পরেই ‘লৌহযবনিকা’ ‘লৌহকপাট’ নামে আর ‘বিশ্ববন্ধু’র বদলে ‘জরাসন্ধ’ নাম দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। এর কিছুদিন পরে ১৯৫৪ সালে ‘লৌহকপাটে’র প্রথম খণ্ড গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৮ সালে তপন সিংহ সেটি নিয়ে সিনেমা করেন।