আমরা প্রতিদিনই এমন কিছু কাজ করি যাতে কোনও না কোনওভাবে পরিবেষ দূষিত হয়, গাছপালা-নদীনালা-পশুপাখির জীবন বিপন্ন হয়। কেউ কেউ আবার নিজেকে এমন কাজে নিয়োজিত করে যে কাজের কারণে পরিবেষ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা পায়। বস্তুতপক্ষে সেই কাজের জন্য তার আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনও সুযোগ নেই কিন্তু আনন্দের সঙ্গেই সে ওই কাজ করে চলে নিষ্ঠার সঙ্গে।
গুজরাট রাজ্যের জুনাগধ শহরের বাসিন্দা হরসুখ ভাই দোবারিয়াকে সবাই বার্ড ম্যান বলেই চেনেন জানেন। এক সময় তিনি শহরেই থাকতেন। পাখির প্রতি তীব্র ভালোবাসার কারণে তিনি নিজের ঠিকানা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন। বিপুল সংখ্যক পাখি আসার কারণে প্রতিবেশীরা প্রায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করত- পাখিদের কিচিরমিচির ডাক নিয়ে। কিন্তু পাখিদের ডাকাডাকিতে অনেক বিরক্ত হলেও তিনি এটাকে তাঁর জীবনের অংশ হিসেবেই মনে করেন। তাই প্রতিবেশীদের আভিযোগ আমলে নিয়ে তিনি ২০১২ সালে শহরের পাশে চার একর জায়গা নিয়ে তার স্বপ্নের পাখি আশ্রম গড়ে তুলেছেন।
বার্ড ম্যানের ভালবাসায় জুনাগধ পাখি আশ্রমে পাখির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন ৩ হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। বিপুলসংখ্যক এই পাখিদের ভরণ পোষণের ব্যায়ভার খুব একটা কম নয়। তবে গোটা ব্যাবস্থাটাই একার হাতেই করে চলেছেন হরসুখ ভাই দোবারিয়া। পেশায় কৃষক এই মানুষটি খুব বেশি অর্থ বিত্তের মালিক না হলেও তার রয়েছে একটি মহৎ হৃদয়। তবে হরসুখ একা নন, তার পরিবারের সকলেই পাখিদের এই প্রতিপালন আনন্দের সঙ্গেই করেন।
পাখিদের প্রতি ভালবাসা, তাদের জন্য আশ্রম গড়ে তোলা, বিশেষত যেখানে তিন হাজারের ওপর পাখি আশ্রয় নিয়েছে সেটা দু-এক বছরের যে ব্যাপার নয় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঘটনার শুরু আজ থেকে প্রায় ১৯ বছর আগে। দুর্ঘটনায় পা ভেঙে যায় হরসুখের। সে কারণে তাকে বেশ কিছুদিন বিশ্রামের জন্য গুজরাটের জুনাগড় জেলায় থাকতে হয়। সেখানে তার সামান্য কিছু ভূ-সম্পত্তি আছে। সেই ক্ষেতে মিলেট (ভুট্টাজাতীয় এক ধরণের শস্য) আবাদ হত। সেখানে বাড়িতে শুয়ে বসেই তার দিন কাটছিল।
একদিন এক প্রতিবেশী তার কাছে পোষা টিয়া পাখিকে খাওয়ানোর জন্য মিলিট দানা নিতে আসে। ওই প্রতিবেশী চলে যাওয়ার পর হরসুখের মাথায় কি এক চিন্তা খেলে যায়। সেও নিজের ঘরের বারান্দায় একটি মিলিট ঝুলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পরে একটি টিয়া এসে খেয়ে যায় সেটি। হরসুখ পরদিনও মিলিট ঝুলিয়ে দেয়। সেদিন দুটি টিয়া আসে। এইভাবে প্রতিদিন হরসুখ মিলিট ঝুলিয়ে রাখে আড় প্রতিদিন টিয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর কেবল টিয়া নয় সঙ্গে আসে চড়ুই। এক মাস পর টিয়া ও চড়ূইয়ের সংখ্যা দাঁড়াল প্রায় ১৫০টি। এভাবে বাড়তেই থাকল পাখির সংখ্যা। ব্যালকনিতে আর যখন ঠাঁই হচ্ছিল না, তখন তিনি খোলা জায়গায় স্ট্যান্ড বানিয়ে মিলেটের খোসা তাতে গেঁথে রাখা শুরু করেন। এতে পাখিদেরও সুবিধা হলো। আর বাড়তে থাকল তাদের সংখ্যা।
১৯ বছর ধরে প্রতিদিন তিনি কয়েক হাজার পাখিকে খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু হরসুখ ভাই দোবারিয়া এত পাখি যে খাঁচায় পোষেন না সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বনের মুক্ত পাখিদেরই তিনি খাওয়ান। আর পাখিরাও তাকে ভালোবাসে। প্রতিদিন সময়মতো তারা চলে আসে প্রিয় মানুষের হাতে খাবার খেতে। অনেক পাখি আবার তাদের বনের ঠাই ছেড়ে বাসা বেঁধেছে হরসুখ ভাইয়ের খামারের আশপাশেই। কারণ, খাবারের জন্য এখানে-সেখানে ওড়াউড়ির ঝামেলা তাদের করতে হয় না। তাই নিশ্চিত খাবার যেখানে পাওয়া যায়, সেখানে বাসা বেঁধে থাকাই শ্রেয় মনে করেছে তারা। প্রতিদিন তিন হাজারের বেশি টিয়া ও চড়ূই তার চার একরের খামারে খেতে আসার ফলে জায়গাটা হয়ে উঠেছে পাখিদের এক অভয়ারণ্য।