সফরসঙ্গীদের অধিকাংশ সুরাসক্ত(গোদা বাংলায় মোদোমাতালও বলা যায়)। স্বভাবতই বাড়ি থেকে উঠল তীব্র আপত্তি। ছাড়পত্র দেয়নি মাও। তাই বাতিল হল এবারের গঙ্গাসাগর সফর। একেবারে শেষমুহুর্তে যেতে না পারায় আক্ষেপ ছিল। সেটা কাটাতে যেন এগিয়ে এল ছোটভাই। তিনদিনের ছুটিতে স্কুল ফেলে যে এসেছে মায়ের কাছে।
দুপুরে একরকম ভুরিভোজের পর বলল, ‘দাদা চল, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কাছেপিঠে কোথাও ঘুরে আসি। তাহলে বিকেলের এক্সারসাইজটাও হয়ে যাবে’। স্বাস্থ্য সচেতন ভায়ের সেই ডাকে অগত্যা সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
এখন লট ৮-এ এখন সাগরযাত্রীদের জমজমাট ভিড়। তা এড়াতে দু জনের সাইকেল ছুটল ঘটিহারার দিকে। কালনাগিনী খাল ও নদীর পাশ দিয়ে সেই ১২ নম্বর তথা লট ১২ এর উদ্দেশ্যে।
কাকদ্বীপ প্রতাপাদিত্যনগর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মাঝে বয়ে চলেছে খালটি। একটা সময়ে এটাই ছিল ১২ নম্বর সহ দুই কাশিয়াবাদ(১৫ ও ১৬ নম্বর লট), গঙ্গধরপুর কিংবা পাথরপ্রতিমা যাওয়ার সোজাসাপটা জলপথ ।
তবে সময়ের ফেরে কালনাগিনী খাল এখন ক্রমশই মজছে। তাই বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলির সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের যোগাযোগে হয়েছে পাকাপোক্ত সেতু তথা ওভারব্রিজ। তবে ‘উন্নয়ন’এর এমন আগ্রাসনে, আরও সংকুচিত হয়েছে খাল আর নদী। তাছাড়া নদীর চরও বেদখল হয়ে চলেছে দ্রুত।
খালপাড়ের বাইন গাছের জঙ্গল এখন একরকম উধাও। তাছাড়া দেখাও মেলে না কেয়া, গোলপাতা কিংবা হেতালের মতো সুন্দরবনের একসময়ের অতি পরিচিত ম্যানগ্রোভ।তবে যাত্রাপথে আচমকা দেখা মিলেছিল হেতালের কয়েকটি ছোটঝোপ। সুন্দরবনের বাঘের গা ঢাকা দেওয়ার বড় প্রিয় এই হেতাল বন।
নদীচরের ম্যানগ্রোভের জঙ্গল বর্তমানে উধাও যেমন হয়েছে, তেমনি নিত্যনতুন গড়ে উঠছে জনবসতি। সেখানে মাথা তুলছে পাকার ঘর। আর একের পর এক ঘেরা ফিশিং ঘাট। ফলে ওপর থেকে আগের মতো দেখাই মেলে না বয়ে যাওয়া নদী।
ভোটব্যাঙ্ক বড় বালাই। তাই খালপাড়ের দখলদারি নিয়ে হেলদোল নেই জেলা কিংবা ব্লক প্রশাসনের। তাই দ্রুত জনবসতি তেমন গড়ে উঠছে, তেমনি বেড়েছে নোঙ্গর করা মাছ ধরার ট্রলারের সংখ্যা। কোথাও আবার জবরদখল করা চলে রয়েছে পেল্লাই সাইজের গোডাউনও।
আলো পড়ে আসছিল দ্রুত। ততক্ষণে আমরা প্রায় কিলোমিটার পাঁচেক পার হয়ে পৌঁছেছি ঘটিহারা ফেরিঘাটে। একটা সময় এখান থেকেই মিলত পাথরপ্রতিমা যাওয়ার লঞ্চ। এখান নদী খালের আড়াআড়ি জুড়েছে ওভারব্রিজ।
ব্রিজ পার হওয়ার সময় মুঠোফোনে ফ্রেমবন্দি হল অস্তগামী সূর্য, খাল আর বাইনের জঙ্গল। তবে অনভ্যাসে তা মনমতো হয়নি। তাছাড়া ভাঙাচোরা পিচ রাস্তা আরও কিছুটা পার হওয়ার পর পৌঁছে গেলাম ১২ নম্বর লটের থানগড়া সতীশচন্দ্র বিদ্যাপীঠে। বছর ৫০ পার করা এই উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে ভায়ের এক পরিচিত একসময়ে ছিলেন। তাই একটা বাড়তি তাগিদ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে দেখার।
সূর্য আরও ঢলে পড়তেই বাড়ল কনকনে উত্তুরে হাওয়ার দাপট। যা মাঝেমধ্যে জ্যাকেট ফুঁড়ে কাঁপুনিও ধরাচ্ছে। অন্ধকার আরও গাঢ় হওয়ার আগে ফিরতে হবে। তাড়া লাগলাম ভাইকে। সওয়ারি সহ ফিরতি পথ ধরল ২ সাইকেল। মাঝে টোটো স্ট্যান্ড লাগোয়া দোকানে সদ্য তৈরি চায়ে চুমুক। অসাধারণ চায়ের সঙ্গী নিমকি। কাঠের উনুনে গরম তেলে কুচো পেঁয়াজি তখন হাবুডুবু খাচ্ছে। তা দেখে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা।