জন্মেছিলেন কলকাতার হ্যারিসন রোডের একটি বাড়িতে। তাঁকে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয়। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় জ্যোতিকিরণ বসু। স্কুলে ভর্তির সময় তাঁর নাম থেকে ‘কিরণ’ শব্দটি ছেঁটে দেওয়া হয়। স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। ওই বিদ্রোহের বিরোধিতা করে স্কুলে লিফলেট বিতরণ করা হয়। তিনি তার প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন জেগেছিল, বিপ্লবীরা তো দেশের স্বার্থেই বিদ্রোহ করেছেন।
এরও আগে ১৯২৬ সালের আগস্ট মাসে শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ বেরিয়েছিল। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই বইটি নিষিদ্ধ হয়। স্কুলের ছাত্র হয়েও তিনি নিষিদ্ধ উপন্যাস লুকিয়ে সংগ্রহ করে পড়েছিলেন।
ছোটবেলা থেকে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা তাঁর বাবা-মা নিশিকান্ত ও হেমলতা বসুর ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সহমর্মিতার কারণে। বিপ্লবী মদনমোহন ভৌমিক নিশিকান্ত বসুর বাড়িতে বেশ কিছুদিন আত্মগোপন করে ছিলেন। মাঝে মধ্যে অস্ত্রও লুকিয়ে রাখতেন। একবার ব্রিটিশ পুলিশখবর পেয়ে নিশিকান্তের বাড়ি তল্লাশী করতে আসে। পুলিশের কাছে সঠিক খবরই ছিল। সেই সময় মদনমোহন ভৌমিক নিশিকান্ত বসুর বাড়িতে একটি পিস্তল লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তল্লাশি করে ব্রিটিশ পুলিশ নিশিকান্ত-র বাড়ি থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারে না। কারণ, তাঁর মা হেমলতা তাঁর শাড়ীর ভাঁজে অস্ত্রটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। এই ঘটনাটি তিনি ছোট বেলা থেকে মা-বাবার কাছে প্রায়ই শুনতেন। তাঁর মানস-চেতনায় তাঁর বাবা-মা-র জীবনের এই ঘটনা দেশপ্রেমের বীজ বোনে।
১৯৩৫ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স পাস করার পর তাঁর বাবা ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাঁকে বিলেত পাঠান। সেখানে একটি বাড়িতে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় ভূপেশ গুপ্ত, ব্রিটেনের কমিউনিস্ট নেতা হ্যারি পলিট, রজনী পাম দত্ত, বেন ব্র্যাডলে প্রমুখের সঙ্গে। এই সময় থেকেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৮ সালে তিনি ও তাঁর সহকর্মীদের উদ্যোগে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর বিলেত সফরের সময় এক সভার আয়োজন করা হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর বিলেত সফরকালেও একই ধরনের উদ্যোগ নেন তিনি।
১৯৪০ সালে তিনি ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। একটা সময়ে পার্টি তাঁকে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়। ১৯৪১ সালে তিনি বিয়ে করেন বাসন্তী ঘোষকে। বিয়ের অল্পদিন পর ১৯৪১ সালেই টাইফয়েডে মারা যান বাসন্তী ঘোষ। কিছুদিন পর তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়। ১৯৪৬ সালের তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় কংগ্রেসের হুমায়ুন কবীরকে আট হাজার ভোটে পরাজিত করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি মোট তিনটি আসন পেয়েছিল। তাঁর সঙ্গে দার্জিলিং কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা রতনলাল ব্রাহ্মণ ও রূপনারায়ণ রায়।
১৯৪৭ সালে তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বিধানসভায় ভাষণ দেন। স্নেহাংশু আচার্যের সঙ্গে ছুটে যান ময়মনসিং হেহাজং যোদ্ধাদের পাশে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন কমলা বসুকে। স্বাধীন দেশে বিধানসভা অধিবেশনের প্রথম দিনেই জনসাধারণের উপর কংগ্রেসী সরকারের পুলিশী দমন-পীড়নের সমালোচনা করেন। কিছুদিন পর কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলে গ্রেপ্তার হন তিনি। বিনা বিচারে ৩ মাস আটক থাকার পর মুক্তি পান। এরপর তিনি পার্টির পরামর্শে আত্মগোপনে চলে যান। ‘বকুল’ ছদ্মনামে গোপনে পার্টির সংবাদ পৌঁছে দেন নেতৃত্বের কাছে। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে রান্না করা, ঝাঁট দেওয়া, বাসন ধোওয়া ইত্যাদি কাজও করেন।
১৯৫৩ সালের ট্রামভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনের সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ওই সময় তিনি কালাকানুনের বিরোধিতা করেন। ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় বসে শিক্ষক আন্দোলনের উপর দমন-পীড়নের নিন্দা জানিয়ে তিনি সরকারকে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়ার কথা জানান। বিধানসভা থেকে বেরোতেই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে দু’দিন জেলে আটকে রাখে। এরপর ১৯৫৩-৫৪ সাল পর্যন্ত ষষ্ঠ রাজ্য সম্মেলনে পশ্চিমবঙ্গ পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে বরানগরে কংগ্রেস প্রার্থী কানাইলাল ঢোলকে পরাস্ত করে তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হন জ্যোতি বসু।
১৯৬১ সালে অন্ধ্র প্রদেশের বিজয়ওয়াদাতে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ডাঙ্গের নেতৃত্বাধীন সংশোধনবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যে বত্রিশজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ওয়াকআউট করেছিলেন জ্যোতি বসু তাঁদের মধ্যে ছিলেন। ১৯৬৫ সালে সি পি আই (এম) কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র পিপলস ডেমোক্র্যাসি আত্মপ্রকাশ করলে জ্যোতি বসু হন তাঁর প্রথম সম্পাদক। ১৯৬৭ সাল থেকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে যে বাম হঠকারিতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত হয়েছিল বসু ছিলেন তার সামনের সারিতে।
১৯৬৭ সালে বরানগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের অমরেন্দ্র ভট্টাচার্যকে হারিয়ে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে শ্যামপুকুরে হেমন্ত বসুকেহত্যা করা হয়। ওই বছর অজয় মুখার্জিকে পরাজিত করে ফের নির্বাচিত হনজ্যোতি বসু। কিন্তু সর্বাধিক আসন পাওয়া সত্ত্বেও রাজ্যপালসিপিআই(এম)-কে সরকার গঠনের জন্য ডাকলেন না। ১৯৭২ সালের নির্বাচনকে জ্যোতি বাবুরা প্রহসন আখ্যা দিয়ে ওই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকারের আবির্ভাব হয়। সাতগাছিয়া কেন্দ্রে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে বিধানসভায় ফিরে এলেন জ্যোতি বসু। এবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। তখন তাঁর বয়স ৬৩ বছর।