ক’দিন ধরেই বিরক্তিকর পরিবেশ। কাজকম্ম নেই বললেই চলে।কাজ বলতে গণমাধ্যমের কর্মী আর কতকটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো আর কি! দু’তিন জন মিলে ঠিক করলাম মাচানতলা ছেড়ে রেলস্টেশনে জমিয়ে আড্ডা দেবো আজ। আমাদের আড্ডা আর ভাবনা চিন্তা দুটোই একটু অন্য ধরনের। আসলে আড্ডার টেস্ট বদল আর নতুন করে পুরানোকে দেখার বাসনা। এক কথায় বলা যায়- বাসনা বিলাসী বাউন্ডুলে। তাই আড্ডাকে প্রায়োরিটি দেওয়াই আমাদের কাজ। আড্ডারও রূপ আছে। রঙ আছে। আছে কোয়ালিটি। পাশাপাশি তার ভেতর থেকে বেরোয় স্পেশ্যাল স্টোরির মোক্ষম আইডিয়া। এই মূল্যবান আইডিয়া থেকেই চ্যানেলের টিআরপি-র হার উর্ধমুখী হয়। সাধারণ মানুষ যারা নিষ্ঠাবান দর্শক তাদের মনের মধ্যেও পজিটিভ এ্যাফেক্ট পড়ে। যার রেশ থাকে দৈনন্দিন জটিল সমাজ জীবনে। যা জৈবনিক ভাবনার খোরাক হয়ে ওঠে নিত্যদিন। এমনই একটি অসামান্য জীবনবোধের উৎসমুখের কথা বলছি আজ। শুধু ইউনিক ভাবনাই নয়, সমাজ দর্শনের মাইল ফলকও বটে।

বাঁকুড়া ছোটো স্টেশনের পার্কিং জোনে বাইক রেখে লাইন টপকে এলাম বড় স্টেশনের একদম সামনে। আমাদের জেলায় এখনও ‘ছোট রেল’, ‘বড় রেল’ বলার চল আছে। আদপে বড় রেলওয়ের নাম হল- বিএনআর, বাঁকুড়া নাগপুর রেলওয়ে। আর ছোট রেল বলতে বোঝায়- বিডিআরআর, বাঁকুড়া দামোদর রিভার রেলওয়ে। যদিও আজ ছোট থেকে বড় রেলওয়েতে পরিণত হয়ে গেছে সেদিনের- ‘বড় দুঃখের রেল’ কিম্বা ‘বড় দাদুর রেল’। পুরানো দিনের ঠাট্টা, অবহেলা, উপেক্ষা সহ্য করতে হয় না আর। বন্ধ হয়ে গেছে তাকে ঘিরে রঙ্গ তামাসা। সেদিনের এই দুঃখের রেল আজ মানুষের দুঃখ মোচন করে চলেছে। বড় লাইন হয়েছে। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনে চলে যাত্রীবাহী ট্রেন।
এখন বাঁকুড়া থেকে মশাগ্ৰাম হয়ে সহজেই বর্ধমান মেইন লাইনে ওঠা যায়। সেখান থেকে সোজা হাওড়া যাওয়া যায়। অতীতের সেই সাবেকিয়ানা ও নস্টালজিয়াও হারিয়ে গেছে ন্যারোগেজ লাইনের সঙ্গে। শুধু “মহারানি ভিক্টোরিয়া” হয়ে সেজেগুজে আছে এক “কৃষ্ণসুন্দরী”। আদপে এই কৃষ্ণসুন্দরী হল একটি কয়লা আর জল দিয়ে চালানো বাষ্পীয় ইঞ্জিন। D-12 নামের এই ইঞ্জিনটি বড় স্টেশনের সামনে মুখোমুখি শোভাবর্ধন করে চলেছে কয়েকটি প্রজন্ম ধরে। দেখে অনেকেই মুগ্ধ হয়। আবার অনেকেই সেলফি মোডে মজে থাকে। গ্লাসগো,ইউ. কে .তে জন্ম নেওয়া এই সেকেলে ইঞ্জিন আজ আমাদের কাছে হেরিটেজ তকমায় বিভূষিত। কেটলি থেকে বাষ্পীয় শকটে রূপান্তরের জনক মাননীয় জেমস্ ওয়াটসকে স্যালুট জানিয়ে চললাম আপন পথে।

আমরা রেলচর্চা ছেড়ে একেবারে সামনের দিকে হাঁটছি। শীতের বিকেলে কমলা রোদ্দুর মোলায়েম আবেশ আনে সবারই মনে। তবে শহুরে কেতায় এখনো শাল সোয়েটার বেরোয়নি আলমারি থেকে। সাকুল্যে দু’চার জন দূর দেশের যাত্রী পরে বেরিয়েছেন। ঝাঁ চকচক করছে প্লাটফর্ম চত্বর। স্টেশনের মেঝে সদ্য ধুয়ে মুছে গেছে কোনও রেলকর্মী। অগত্যা পাশে ব্যাগ রেখে মেঝেতেই বসে পড়লাম আমরা। পরবর্তী এপিসোড আমাদের ‘চপমুড়ি ভোজন পর্ব’। অনুপ ট্যাপ থেকে বোতলে জল ভরে আনলো। শোভন কাগজ পেতে মুড়ি, চপ, শশা আর লঙ্কা, পেঁয়াজ সহযোগে মাখা শুরু করলো। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখছি। দেখে চলেছি পঞ্চ ভূতকে। উপরে মুখ তুলে দৃষ্টি ফেরাতেই নজরে পড়ল আমার না দেখা এক অনির্বচনীয় দৃশ্যপট। উন্মুক্ত আকাশে ডানা মেলে সার বেঁধে উড়ে চলেছে পাখিদের দল। কি সুন্দর তাদের গমন পথ! যেন ডানা আর পা দিয়ে ছবি এঁকে যায় আকাশের বুকে। আদিগন্তের ক্যানভাস পূর্ণতা পায় তাদের উড়ে যাওয়া গমন রেখায়। ক্ষণিকের মধ্যে মিলিয়ে গেলেও দৃশ্যপট রয়ে যায় মনের কোনায়। কোথায় গন্তব্য তাদের? তাদের তো কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই, গোষ্ঠীও নেই। তাদের নিজস্ব ঘরও নেই। জল জঙ্গল ও জমি নিয়ে কিম্বা আকাশ দখলের জন্য মারপিট করে না। হানাহানি বা দখলদারিও নেই নিজেদের মধ্যে। শুধু দিবা অবসানে রাতটুকুর জন্য তাদের ফেরা। নিরাপদে স্বজন পরিজন নিয়েই তাদের জগৎ-সংসার।

স্টেশনের ওপারেই আছে বহু পুরানো কালের অশ্বত্থ আর বট গাছ। তাদের অবলম্বন করে অগুণতি নাম না জানা হরেক প্রজাতির পাখি বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। মানুষও কি পাখির জাত? এই ফাঁকা ছিল প্লাটফর্ম এক লহমায় ভরে গেল গোটা চত্বর। মনের অজান্তেই প্রশ্ন জাগে মানব জীবনের এই চলন গমন নিয়ে। রেলের ইস্টিশন যেন একটি বড় গাছের রূপক। হাঁকডাক, ঠেলাঠেলি মিলিয়ে যায় গাড়ি চলে গেলেই। পাখিদের সম্মিলিত কলরব ঘোষণা করে শান্তির নীড়ে ফেরার বার্তা। মানুষও পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে ট্রেনে চড়ে লক্ষ্যে পৌঁছানোর তাগিদে। বহুধা শ্রোত একমুখী হয় আপন আপন লক্ষ্যে। ট্রেনে তো কোনও জাতি ধর্ম ভেদ নেই? হকার-বেকার, ফেরিওয়ালা, ভিখিরি এমনকি সমাজ বিচ্ছিন্ন একদল রোগাক্রান্ত মানুষ দিব্যি সিটে বসে লক্ষ্যে পৌঁছাতে মরীয়া। প্রতিটি মানুষেরই কাঙ্খিত গন্তব্য আছে।আগামীর প্রতিশ্রুতি আছে। শুধু প্রতিদিন দিনান্ত কালে দিনবদলের ডাক দিয়ে যায় ডুবন্ত দিবাকর। তাকে নিয়ে আমাদের ভাবনা বিস্তর। তবুও ওঠে ডোবে চিরন্তন ধারায়।

সাত পাঁচ ভাবনার মধেই এসে হাজির হলো বারো জনের একটি দল। মাধুকরী পর্বের সমাপ্তি ঘটে এই ইস্টিশনের বুকেই। সূচনা থেকে সমাপ্তি সাক্ষী থাকে এই রেলগাড়ি আর অগণিত মানুষ। তাদের জোটবদ্ধ সাম্যবাদে মোড়া জীবনের পরম ভরসা এই রেলপথ। মাথায়-কাঁখে ও দুই হাতে বোঁচকা বুঁচকি। বাটি ও পুঁটলি নিয়ে বসে পড়লো আমাদের ঠিক পাশেই। দলটির মধ্যে আটজন মহিলা ও চারজন পুরুষ। এরা সবাই এক একজন সংসার জীবনের যোদ্ধা। তাদের কেমেস্ট্রিই বলে দেয় অভিযোজন তত্ত্বের লড়াইয়ে সামিল হওয়ার কথা। জরাজীর্ণ ও শ্রীহীন শরীর নিয়েই তাদের বেঁচে থাকার লড়াই। নিজেরা বাঁচে অন্যদেরও বাঁচিয়ে রাখে নিরন্তর। জীবনের সঙ্গে জীবনের যোগ তাদের কাছে এক মহার্ঘ বেদ উপনিষদ কিম্বা পুরাণ। অতলান্ত জীবন নদীর তীরে তাদেরও সামগান গাইতে হয় তাদের সাম্যবাদের দর্শনকে বাঁচিয়ে রাখতে। এখানেই শুধু আমাদের কৌতুহল বেড়ে গেল অভিব্যক্তির চিরকালীন ব্যাপ্তিতে। তাদের বৃত্তাকার অবস্থান দেখে গভীর কৌতুহল জাগলো মনের কোনায়। অনুপ আর শোভন ডিভি ক্যামেরায় সেই দৃশ্যপট আর কথোপকথন রেকর্ড করে চললো।
(পরবর্তী অধ্যায় আগামী রবিবার)