(গত সংখ্যার পর)
পরাণের মাছ ধরা শেষ হয়ে গেছে। খালুই ভর্তি দেশি মাছ আর জাল গুটিয়ে শান বাঁধানো ঘাটে ভেড়ালো জেলে ডিঙিখানি। লম্বা বাঁশের লগি বেঁধে রাখলো কাছিতে। চাটুজ্যে বাড়ির ছেলে মেয়েরা হৈ হৈ করে জলে নেমে তুলে আনা পদ্ম, শালুক ফুল নিয়ে ফিরে এলো দাদুর কাছে। আজ তাদের ভীষন মজা হয়েছে। সারাটা পুকুর ঘুরে নৌকায় চড়ে খুবই আনন্দিত তারা। মনি দাদু স্পষ্ট দেখতে পেলেন তাঁর হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলা। বাবা, জ্যেঠা ও কাকাদের হাত ধরে কতবার গেছে মাছ ধরা দেখতে। সবচেয়ে বদরাগী সেজো কাকা তো বাগানে নিয়ে যেতেন ডাব, নারকেল, চালতা কিম্বা আম, জাম, কাঁঠাল, জামরুল পাড়ানোর সময়। শৈশবের সেই দিনগুলো ছিল হাসিখুশিতে ভরা। আম আর খেজুরের সময় তো আধবেলা কেটে যেত বাগানে। দূরের গাঁ থেকে পড়াতে আসতেন বসন্ত পন্ডিত। পাড়া ঘরের লোক বলতেন, “টুলো পন্ডিত বসন্ত”। ওনাদের বংশ পরম্পরায় টোল চতুষ্পাঠী ছিল। জমিদার বাড়ির ছেলেমেয়েদের সংস্কৃত ব্যাকরণ থেকে ভাষা সাহিত্য পড়াতেন এই বসন্ত পন্ডিত। পড়া না পারলে সে কি ধমক! তিনি ছিলেন তাঁর মনপসন্দ ও বাধ্যের ছাত্র।
ইংরেজি পড়াতেন কেশব মাস্টার। খ্রিশ্চান মিশনারির মেধাবী ছাত্র এই কেশব বাবু ইংরেজি শেখাতেন গল্পের ছলে। কি অসাধারণ বোঝানোর ক্ষমতা তাঁর! আর আসতেন গান বাজনার শিক্ষক গোরাচাঁদ শাস্ত্রী মশাই। তাঁর গলায় ছিল মধূঢালা সুর। গায়ন রীতিতে ছিল স্বতন্ত্রতা। গায়কীতে ছিল নিজস্বতা। তিনি ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার এক উজ্জ্বল ও প্রতিভাবান ছাত্র। তাঁদের গোটা পরিবার ছিল নাচ গান বাজনায় নিবেদিত। শুধু কন্ঠ সঙ্গীতেই নয়, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ, সেতার আর তানপুরা বাজানোয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন তাঁদের পরিবারের লোকজন। সেই সময় “সেনী” ঘরানাকে টক্কর দিতেন কেশব শাস্ত্রীর পরিবারের গায়ক ও যন্ত্রশিল্পীবৃন্দ। মনিশেখর বাবুর উপরের দিদি সৌদামিনী এই নিষ্ঠাভর তালিমের দৌলতেই দেশ বিদেশের মাটি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসর। রীতিমতো লক্ষ্ণৌ থেকে দিল্লি, মধ্যপ্রদেশে গেছেন ধ্রুপদ ঘরানার সঙ্গীত সম্ভার নিয়ে। গোয়ালিয়র রাজপরিবারে পেয়েছিলেন প্রভূত সম্মান আর খ্যাতি। পরবর্তী সময়ে কর্ণাটকের এক উচ্চবংশীয় সঙ্গীত সাধকের সঙ্গে বিয়ে হয়।
চাটুজ্যে পরিবারের অতীত ইতিহাস সব মনে পড়ে যাচ্ছে আজ। মনিশেখরের বাবা ছিলেন দুঁদে আইনজীবী আর তুখোড় টেনিস খেলোয়াড়। কলকাতা, দিল্লি সহ নানা প্রদেশে ছিল তাঁর সুনাম। সুশিক্ষিত ও ভদ্র সংস্কৃতিবান ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে ছিল মধুর সম্পর্ক। বড়শি, হুইল কিম্বা ছিপ দিয়ে মাছ ধরা, ঘোড়ায় চাপা, টেনিস খেলা সহ বছরে কয়েকবার ঘন বনজঙ্গলে শিকারে যেতেন দল বেঁধে।
একবার একই দিনে শুশুনিয়া লাগোয়া গভীর জঙ্গলে ভরদুপুরে তিন চার জনের একটি শিকারী দল গিয়েছিলেন শিকারে। কাঠ পাতা আর বনজসামগ্ৰী সংগ্ৰহে আদিবাসী দলের কাছে খবর পেলেন বাঘ পড়েছে হরিণ দলের উপর। শিকারী দলটি সন্তর্পনে উঠে পড়লেন মাচায়। দু’জন সরে গেলেন ভালুক গুহার দিকে। সবার হাতে দোনলা বন্দুক। পড়ন্ত বেলায় তাঁরা স্পষ্ট শুনতে পেলেন শুকনো পাতার খস্ খস্ শব্দ। ক্রমশ সামনের দিকে আরও স্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে শব্দ। এরিকসন সাহেব বাইনোকুলার দিয়ে দেখার চেষ্টা করতেই দেখলেন বাচ্চাসহ দু’তিনটে হরিণ সতর্ক হয়ে ঝর্নার জল পান করতে এগিয়ে আসছে। আরও ভালো করে কান খাড়া করতেই কিছুটা দূরে আবার পায়ের শব্দ শোনা যায়। আচমকা ছোট ছোট জীবজন্তু পাখির কোলাহল শোনা গেল। মনে হলো যেন ত্র্যস্ত হয়ে উঠেছে বন। আগাম বিপদের গন্ধ এভাবেই ছড়িয়ে দেয় গোটা বনকে। শুকনো পাতার হেঁটে চলার শব্দ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল কয়েক মূহুর্ত। জীবজন্তু, পশুপাখির ডাকও থমকে গেছে। কয়েক মিনিট পরই আবার শুকনা পাতার উপর পদসঞ্চার শোনা যায়। আরও কাছাকাছি আরও সুস্পষ্ট শোনা গেল সেই শব্দ। সবাই বন্দুক উঁচিয়ে তাক করতেই হরিণ দলে থাকা পূর্ণ বয়স্ক দলপতি আচমকা বিপদের বার্তা সূচক ডাক দিয়ে উঠলো। কোনও কিছু বোঝার আগেই তীর গতিতে জোড় পায়ে ঝাঁপ দিল শার্দূল চিতা। বন পাহাড় ভেদ করে গুড়ুম্! গুড়ুম্! গুলির শব্দ আছড়ে পড়লো নির্জন বনপ্রান্তে।
চলবে