সূর্য তখন ডুবু ডুবু। অজয়ের চর প্রায় ফাঁকা। অথচ নদী বাঁধে উপচে পড়া ভিড়। ছবি তুলতে তুলতে কিছু না ভেবেই অজয়ের চরে নেমে গেলাম। দেখি সাদা লালপেড়ে শাড়ি পরিহিতা এক মহিলা বসে সাজু গুজু করছে। এক জটাধারি দাঁড়িয়ে। দুজনে বিড় বিড় করে কথা বলায় মগ্ন। আমি যে ক্যামেরায় ক্লিক করে চলেছি ওদের খেয়ালই ছিল না। বেশ কিছু পরে লক্ষ্য পড়ল আমার দিকে।
জটাধারি- তুলে নিলেন?
-হ্যাঁ।
কপালে হাত ঠেকিয়ে নমষ্কার করল। বুঝলাম কেস খাইনি।
মহিলাকে বললাম, কি এত সাজছো গো, কোথায় যাবে?
-কোথায় আর যাব বাবু? চান করলাম, তাই একটু…
সিঁদুর পরা, গালে ক্রিম লাগানো সবই করছিল অতি যত্নে।
জটাধারি কথা বলা শুরু করল নিজে থেকেই। সব যে কানে ঢুকছিল তা নয়। যা বুঝলাম ওর মূল বাড়ি রায়গঞ্জে। কামাখ্যায় থাকে। প্রায় সমস্ত মেলায় যায়। মহিলাকে দেখিয়ে বললাম, এ কি তোমার ক্ষেপি?
-হ্যাঁ গো। ভবা পাগলার আশ্রমের কাছে থাকে।
ক্ষেপি দেখি ক্ষ্যাপার কাঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল পোজ দিয়ে। ক্যামেরার তুললাম কয়েকটা। যা দেখানো যাবে না এখন। যাই হোক আরও কিছু কথাবার্তার পর সামান্য ক’টা টাকা ওদের হাতে দিয়ে বললাম কিছু খেয়ো তোমরা।
কাউকে কিছু দেওয়ার ব্যাপারে আমি খুব নার্ভাস ফিল করি। কেউ যদি কিছু ভাবে? সবাই কি দান নিতে চায়? এদের দুজনের জুটিটাকে এত ভালো লাগল কিছু দিতে ইচ্ছে করছিল। ক্ষ্যাপা আবেগ তাড়িত হয়ে চোখে জলও এনে ফেলল। মানুষগুলোর কত অল্প চাহিদা, আর আমাদের যেন শান্তি নেই কোনো কিছুতেই!
বিদায় জানিয়ে যখন ফিরবো ক্ষ্যাপা বলল, একটা গান শুনবেন না?
-নিশ্চয়ই।
আমি আর কি বলবো! পড়ন্ত বেলায় অজয়ের নির্জন চরে ক্ষ্যাপার দু কলি গান মন ভরিয়ে দিল। বড় লোভ বাড়িয়ে দেয় এই মানুষগুলো। এদের টানে বেরিয়ে পড়তেই হয়। ভালো থাকুক ক্ষ্যাপা ক্ষেপি।
দুই
সনাতন, আসলে সোনা ক্ষ্যাপা বলে পরিচিত। ওর কথা শুনেছিলাম, আজ সরাসরি আলাপ হলো। পরিচয় হতে বুঝলাম এক ছাত্রর মাধ্যমে আগে থেকেই আমার কথা জানত।
আমরা ক’জন ঢোকার সাথে সাথেই ক্ষেপিকে বলল চা বানাতে। পিগমিদের মত ইগলু-সম ঘরে বসার আওহ্বান জানালেও, শারীরিক প্রতিবন্ধতার কারণে অতোটা আবেগে ভাসতে পারলাম না।
বললাম বাইরের বেদিতে বরং বসা যাক। ক্ষেপিকে বলল মোড়া দিতে। যদিও ওটা আমার অগ্রজের দখলে গেল। ওরও কিছু সমস্যা আছে। অগত্যা মেঝেতেই বসলাম। ছোটো নীচু ঘরে নীচু হয়ে ঢুকতে হলো না এই ঢের।
এর মধ্যই সনাতন দোতারা নিয়ে বসে পড়েছে। গান পাগল মানুষ। ছেলেকে ডাকল করতাল বাজাতে। দীপ্তীশের ডুপকি তো ছিলই। আমরা ঘুঙুর, খঞ্জ টঞ্জ নিলাম। দুলালও এসে পড়ল আর একটা দোতারা নিয়ে।
সনাতন দিন কয়েক গেয়ে আর গাঁজা টেনে গলার বারোটা বাজিয়েছে বোঝা গেল। এও বুঝলাম ওর কন্ঠে এমন কিছু আছে যা অনেকের নেই। একই ভাবে দোতারাতেও। অসাধারণ কিছু ক্লাসিকাল টাচ শুনলাম এক কথায় অসাধারণ।
যাই হোক ক্ষ্যাপার একটু ঝলক রাখলাম। অনেক করে বলছিল দুপুরে ওখানে যেন খেয়ে আসি। মৎস-মুখের ব্যবস্থা ছিল। বড় কড়াইয়ে মাছ ভাজা চলছে দেখলাম। কিন্তু আমাদের উপায় ছিলনা। গতরাতের বাসি খিঁচুড়ির সদগতি করার দরকার ছিল।
সন্ধ্যেবেলা আর একবার যেতেই হবে। দেখি আর কি জোটে!
কেঁদুলি, ১৬/০১/২০২৪