(প্রথম ভাগ)
তপন মল্লিক চৌধুরী
ফের বন্যার কবলে নিম্ন দামোদর এলাকা। এই বন্যা আগের বছরগুলির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন, ‘ম্যান মেড’ আর ডিভিসি রাজ্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করেই জল ছাড়ছে। তবে এর আগে তিনি কিন্তু দুটি প্রশ্ন তুলেছিলেন, প্রথমটি, কেন্দ্র সরকার ডিভিসির জলাধারগুলিতে ড্রেজিং করছে না কেন? অন্যটি ডিভিসি-র বাঁধগুলির কার্যকারীতা এবং পরিচালনা নিয়ে।
হান্টার সাহেব লিখেছেন,“দামোদরের বিধ্বংসী বন্যার জন্য এই নদকে ‘দুঃখের নদী’ বলা হত। হান্টার তাঁর ১৮৭৬-এর রিপোর্টে এও লিখেছেন যে দামোদরের হঠাৎ বন্যাকে “হড়কা বান” বলা হত। রেকর্ড অনুযায়ী দামোদরে প্রথম বন্যা হয় ১৭৩০ সালে। তারপর থেকে প্রায় প্রতি সাত-আট-দশ বছর অন্তর অন্তর বিভিন্ন জলপ্রবাহে দামোদরে বন্যা হয়েছে। তবে ১৯৭৮-এর বন্যা সর্বকালীন রেকর্ডকে ছাপিয়ে যায়। তারপর থেকে দামোদর নদের বন্যা-প্রবণতা বছর বছর ক্রমশই বেড়েছে।
দামোদর-গবেষক কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন, ইংরেজ শাসন, জমিদারি ব্যবস্থা (চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত), চাষি ও জমিদারদের হাতে খাল-নদী-মাটির বাঁধের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়াটাই দামোদরের বন্যা প্রবণতার জন্য দায়ী। কারণ, ব্রিটিশ আমলে বাঁধ নির্মাণে করতে চাষির স্বার্থের চেয়ে গুরুত্ব বেশি পেতে শুরু করে জমিদারদের ব্রিটিশদের কম খাজনা দেওয়ার স্বার্থ। যে কারণে দামোদরের জল বেরিয়ে যাওয়ার পরই খাল রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বন্ধ হয়। ফলে সেগুলি নষ্ট হয় এবং দামোদরের ওপর চাপ বাড়ে।
প্রথমত, নদীপাড়ে বাঁধ তৈরি করতে কৃষকের স্বার্থকে উপেক্ষা কতা হত, পরিবর্তে জমিদারদের খাজনার স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া হত। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের বাণিজ্য ও শিল্পায়নের স্বার্থে নিম্ন দামোদরের বাঁদিকে শহর, রাস্তা, রেলপথ, শিল্পায়ন, খনি গুরুত্ব পেতে থাকলো। অন্যদিকে অবহেলিত হল দামোদরের ডানদিক। কুমকুম ভট্টাচার্য লিখেছেন, ওই সময়ে বন্যার দিনগুলিতে দামোদরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ আসত ১৮,২৭৫ কিউবিক মিটার। সেই জলপ্রবাহ বহন করার জন্য ৩.২ কিলোমিটার চওড়া ও ছয় মিটার গভীর নদের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দামোদর কোথাও ৩.২ কিলোমিটার চওড়া ছিল না। বর্ধমানের ২৫.৬ কিলোমিটার পশ্চিম থেকে আমতা পর্যন্ত জল পরিবহণ ক্ষমতা ক্রমশ কমে গিয়েছিল। অধুনা ঝাড়খণ্ডের উচ্চ পার্বত্য অঞ্চল থেকে যে বিপুল জলরাশি প্রবল বন্যায় দামোদরে আসত তার ৮ ভাগের এক ভাগ দামোদর নিয়ে যেতে পারত। নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা যায় যে; ডান দিকের বাঁধ ভেঙে দিলে বর্ধমানের ৮ কিলোমিটার পশ্চিম থেকে নিচের দিকে বন্যার জলের স্তর ২.৪৪ মিটার থেকে ১.২২ মিটার কমে হবে। কিন্তু ডানদিকের বাঁধগুলি রক্ষা পাবে। ফলত; বর্ধমান শহর, রেলপথ, রাজপথ, শিল্পনগরী রক্ষা করার জন্য ১৮৫৫ থেকে ১৮৫৯ সালের মধ্যে ডানদিকের প্রায় ৩২ কিমি পাড়ের বাঁধ ভেঙে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে বাঁদিকের বাঁধ আরও উচু করা হয়।
বাঁধ দিয়ে (১৮৫০ থেকে ১৯২৫) জলকে প্রতিহত করার ফলে এবং মূল নদের সঙ্গে শাখানদীগুলিকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করার জন্য কৃষিজমির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পায়, এতে মাছের জোগানও কমে যায় এবং এই গোটা অঞ্চল ম্যালেরিয়ার কবলে পড়ে। যে কারণে স্যার উইলিয়ম উইলককস এই বাঁধকে ‘শয়তানি বাধ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ড: বেন্টলি, স্যার উইলিয়ম অ্যাডামস ও স্যার উইলিয়ম উইলককস প্রমুখ বিশেষজ্ঞেরা পশ্চিম ও মধ্যবঙ্গে ম্যালেরিয়ার প্রধান কারণ হিসাবে এই ‘শয়তানি বাঁধ’কেই দায়ী করেছিলেন। তাদের মতানুযায়ী, আষাঢ়ের বন্যায় দামোদর অসংখ্য মাছের ডিম ও চারা মাছ ধানের খেতে ছেড়ে দিত। তারা বাড়তি মশার লার্ভা খেত। অন্যদিকে ডানদিকের অঞ্চল হয়ে গেল চিরকালের জন্য বন্যাদুর্গত। তখন ডানদিকের বন্যা সমস্যা প্রতিরোধে নানা খাল কাটা শুরু হয়, কিন্তু তাতে হয় হিতে বিপরীত। এই সময় নিম্ন দামোদরের উল্লেখিত ডানদিকে একটি খাল কেটে জলনিকাশী তৈরি করতে গিয়ে দামোদরের গতিপথটাই যায় পাল্টে।
দামোদরের এই শেষ পথ পরিবর্তনের জন্য দায়ী জামালপুর থানার নুইদিপুরে ১৮৫৬ সালে দামোদর থেকে ৬ মিটার চওড়া মুচিখাল কাটা। যদিও ওই খাল কাটার উদ্দেশ্য ছিল দামোদরের পশ্চিম পাড়ের রেললাইন, পাড়াবাঁধ সহ বিস্তীর্ণ জনপদকে বন্যার হাত থেকে বাঁচানো। কিন্তু মুচিখাল ভাঙতে ভাঙতে মূল নদে পরিণত হয় এবং মূল দামোদর শীর্ণ হতে শুরু করে। ফের মুচিখাল-এর নিচে একটি বাঁধ দেওয়া হয়। কিন্তু বাঁধটি ভেঙে বেগুয়াহানার ( পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের কাছে) উৎপত্তি হয় ও জলরাশি বেগুয়াহানা দিয়েই প্রবাহিত হতে শুরু করায় নিকটবর্তী অঞ্চল সমূহ বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। তাতেও কি খাল কাটা, জলাধার নির্মাণ পরিকল্পনা থেমেছে? দামোদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া খাতগুলি; যেগুলি দামোদরের পুরনো গতিপথ সেগুলি পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আটকানো যায়নি ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ বন্যা। যে বন্যায় বাঁদিকের বাঁধ ভাঙে।
দামোদর তার এককালে পরিত্যক্ত পথ দিয়ে কালনার কাছে ভাগীরথি গঙ্গার সঙ্গে মিলতে চাইল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে কলকাতা সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রইল এক সপ্তাহ। তারপরই এল ডিভিসি মেগা ড্যাম প্রকল্প। অর্থাৎ, খাল, জলাধার, বাঁধ ইত্যাদির মাধ্যমে দামোদরের জল সঞ্চয় করার মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লাইন, যার কথা ইংরেজদের ইঞ্জিনিয়ার মহলে ১৮৬৪-৬৬ সালে একবার আলোচিত হয়েছিল।
(কাল শেষ)