তপন মল্লিক চৌধুরী
১৯৫৮ সালে ডিভিসি-র প্রধান দুটি জলাধার মাইথন ও পাঞ্চেত তৈরি হয়। কিন্তু ডিভিসি-র জলাধারগুলি তৈরি হওয়ার পর কি দামোদরে বন্যার প্রকোপ কমেছে নাকি বেড়েছে? বন্যা বিষয়ক অন্যতম তাত্ত্বিক গামবেল তাঁর গবেষণা- “The Lower Damodar River, India : Understanding the Human Role in Changing Fluvial Environment”-তে বলছেন, ডিভিসি-র জলাধারগুলি নির্মাণের আগে কয়েকটি জায়গায় প্রায় প্রতি বছরই কূল ছাপিয়ে বন্যা আসত। কিন্তু বাঁধ নির্মাণের পর বন্যার ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ১৪ বছর। তার মানে ডিভিসি-র জলাধারগুলি নির্মাণের পরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাওয়ায় প্রতি চৌদ্দ বছরে একবার নিম্ন দামোদরে কূল ছাপিয়ে বন্যা আসতে পারে, যা জলাধার নির্মাণের আগে প্রতি বছরে একবার করে আসত।
ডিভিসি-র জলাধারগুলি নির্মাণের পর কূল ছাপানো বন্যার সম্ভাবনা অনেক কমেছে। ১৯৭৮ সালের বন্যাকে গত শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বন্যা বলা হয়। ডিভিসি-র জলাধারগুলি না থাকলে দুর্গাপুর ব্যারেজের নিচে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহের পরিমাণ দাঁড়াত ২২,৯৩৯ ঘন মিটার, যা মাইথন ও পাঞ্চেতের জলাধারগুলির জন্য কমে দাঁড়ায় ৪,৬১৬ ঘন মিটার। উল্লেখ্য, তখনও পর্যন্ত দুর্গাপুর ব্যারেজের কাছে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ছিল ১৮,৪০৬ ঘন মিটার। তার মানে যদি জলাধারগুলি না থাকত, তাহলে ১৯৭৮ সালের বন্যার চেহারা দাঁড়াত দামোদরের ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম বন্যা। মানতে হয় কেবল বছর বছর বন্যাই নয় দামোদরে বন্যার প্রকোপ ও তীব্রতা কমেছে।
পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে দেখবো, ১৯৫৮ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত দামোদরে বন্যার বছরগুলিতে, মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার মিলিতভাবে, ঘোর বর্ষার মাসগুলিতে অর্থাৎ জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত জলপ্রবাহ কমিয়েছে বা বন্যা নিয়ন্ত্রণ করেছে ৩২ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। ১৯৭৮ সালে অত ভয়ঙ্কর বন্যাতেও নিয়ন্ত্রণের পরিমাণ ছিল ৭৯ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে ছিল ৫৯ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে ৬৭ শতাংশ। ২০০০ সালে ৪৭ শতাংশ। ২০০৬ সালে ৫২ শতাংশ। ২০০৭ সালে ৩২ শতাংশ। প্রসঙ্গত, বন্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমিয়ে দেওয়াকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মেনে নেওয়া হয়। সেদিক থেকে দেখলে বলা যায়, ডিভিসি-র জলাধারগুলি নির্মাণের পর নিম্ন দামোদরে বন্যার প্রকোপ এবং মাত্রা, দুই-ই কমেছে অনেকটাই।
তার মানে এই নয় যে নিম্ন দামোদরে বন্যা আটকে দেওয়া গিয়েছে। বন্যা হয়েছে ১৯৫৯, ১৯৭৮, ১৯৯৫, ১৯৯৯, ২০০০, ২০০৬, ২০০৭ এবং পরবর্তী বছরগুলিতে। কিন্তু তার প্রকোপ ও তীব্রতা কমেছে। তবে বিশেষঙ্গরা বলেন, হঠাৎ করে আসা ভয়ঙ্কর বন্যায় ডিভিসি জলাধারগুলি কাজের কাজ কিছু করতে পারে না। তাদের স্পষ্ট ব্যাখ্যা, ডিভিসি-র মূল পরিকল্পনায় উঁচু দামোদর উপত্যকায় ৫০৮ মিমি পর্যন্ত বৃষ্টি হলে, অর্থাৎ, সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ ২৮,৩২১ ঘন মিটার/সেকেন্ড পর্যন্ত উঠলেও তা কমিয়ে নিম্ন দামোদরে কূল ছাপানো মাত্রার নিচে নিয়ে আসার লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হয়েছিল, তাতে মোট আটটি জলাধার নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যাদের সম্মিলিত জলধারন ক্ষমতা থাকবে ৩৫৯৫.৬ মিলিয়ন ঘন মিটার। বদলে ডিভিসি তৈরি করেছে দামোদর ও তার উপনদীগুলির ওপর চারটি জলাধার, তিলাইয়া, মাইথন, পাঞ্চেত ও কোনার, যাদের সম্মিলিত জলধারন ক্ষমতা ১২৯২ মিলিয়ন ঘন মিটার। তেনুঘাটে একটি সেচবাঁধ আছে, দামোদর ব্যারেজ।
এছাড়া দামোদর উপত্যকায় হঠাৎ করে অনেক বৃষ্টি হলে ডিভিসি জলাধারগুলি যে বন্যা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশেষঙ্গরা। তারা জানিয়েছেন, ডিভিসি-র চারটি জলাধারে উঁচু এলাকা থেকে যে জল এসে জমা হয় তাদের আবহাক্ষেত্র হল ১৭,১৪৬ বর্গকিলোমিটার। যদি কখনও এই অঞ্চলে তিন দিন গড়ে ৪০-৬৪ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত হয়, তা হলে দামোদরের গড় প্রবাহমাত্রা হবে ১৬,৯৯২ কিউমেক। জলাধারগুলি থেকে তখন ৮,৪৯৬ কিউমেক হারে জল ছাড়া হলেদামোদর নদের প্রবাহমাত্রা হবে প্রায় ১১,৩২৮ কিউমেক। জলাধারগুলিতে ৮,৪৯৬ কিউমেক হারে জল থাকায় ঘন্টা প্রতি জলাধারগুলির ০.০৩ হেকটর মিটার ভরে যাবে। জলাধারগুলির জলধারণ ক্ষমতার মধ্যে যে অঞ্চল বন্যা নিয়ন্ত্রণে খালি রাখা হয় তা মাত্র ৪২ ঘন্টায় ভরে যাবে এবং পরবর্তী ৩০ ঘন্টা বন্যা নিয়ন্ত্রণে জলাধারগুলির কোন ক্ষমতা থাকবে না।
যদিও জলাধারগুলি নির্মাণের ফলে উঁচু দামোদর থেকে আসা পলির পরিমাণ অনেক কমেছে, কারণ সেগুলি ডিভিসি জলাধারগুলিতে জমা হচ্ছে। এই পলি তৈরি হয় উঁচু দামোদরের নদীবক্ষ ও আশপাশ ক্ষয়ে গিয়ে। বিশেষতঃ প্রথম বর্ষায়, যখন সদ্য ফুটিফাটা রোদে মাটি ঝুরঝুরে হয়ে থাকে। ডিভিসি-র জলাধারগুলিতে পলি জমে যাওয়ায় জলাধারগুলির জল ধারন ক্ষমতা কমেছে। নিম্ন দামোদরে ঝাড়খন্ড থেকে আসা পলির পরিমাণ ডিভিসি জলাধার গঠনের কারণে কমে গেলেও নদীর নাব্যতা দ্রুত কমে যাচ্ছে। কারণ ডিভিসি জলাধার নির্মাণের পর জলাধারের নিচের জায়গাগুলো থেকে প্রচুর পলি আহরন করে দামোদর। রাণিগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চল দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় কয়লা-ধোয়ার জায়গা থেকে পলি আসে। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বর্জ্য-জল, শিল্পাঞ্চল থেকে বর্জ্য নালাবাহিত হয়ে আসে দামোদরে। দুর্গাপুর আসানসোল শিল্পাঞ্চলের জলেরও একমাত্র সোর্স এই দামোদর, তাছাড়া দামোদর থেকেই চাষের জল সরবরাহ হয়।
শুধু যে পলি আহরন তাতো নয়, জলের পরিমাণও কমেছে। সব মিলিয়ে যে পরিমাণ পলি জলাধারগুলিতে আটকায়, তার চেয়ে বেশি পলি জলাধারের নিচের শিল্পাঞ্চলগুলি থেকে এসে জমা হয় দামোদরে। দামোদরের জলাধারগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল, দামোদরের বাঁদিকের শিল্পাঞ্চলকে বাঁচানোর জন্য। ফলে শিল্পাঞ্চলগুলি থেকে পড়া বর্জ্যের দায় পরোক্ষভাবে হলেও ডিভিসি-র। কিন্তু জলাধারগুলির কারণে, দামোদরে সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ অনেক কমে গেছে। ফলে দামোদর নদ আর তার জলাধারের নিচের আহরিত পলি ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। নিম্ন দামোদরের নাব্যতা কমে যাওয়ার সবচেয়ে বড়ো কারণ নিম্ন দামোদরের সর্বোচ্চ জলপ্রবাহ কমে যাওয়া, যার জন্য দায়ী জলাধারগুলি।
ফলে ডিভিসির জলাধারগুলি নির্মাণের পর নিম্ন দামোদরে জলপ্রবাহ কমেছে, যদিও বন্যার তীব্রতা ও প্রকোপদুটোই কমিয়েছে। কিন্তু জলপ্রবাহ কমে যাওয়ার পলি আর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারছে না দামোদর, তাতে নদীর নাব্যতা কমেছে, আর জলপ্রবাহতে কূল ছাপানো বন্যা বেড়ে যাচ্ছে। বলা যায়, ডিভিসির জলাধারগুলি নিম্ন দামোদরে বন্যার প্রকৃতিকে পাল্টে দিয়েছে।