কবে এ বঙ্গের বাঙালির পাতে পড়বে বাংলাদেশের ইলিশ, দিন গুনছিলেন ভোজনরসিকরা। অপেক্ষার অবসান ঘটলো বৃহস্পতিবার, জানা গিয়েছে বাংলাদেশ থেকে প্রথম লটের ইলিশ এসে পৌঁছায় পেট্রাপোল সীমান্তে। উল্লেখ্য, চলতি বছর দুর্গাপুজোর আগে পদ্মার ইলিশ পাঠাতে অস্বীকার করেছিল বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার৷ নানা কারণে সেই সিদ্ধান্তের বদল ঘটে এবং ভারতে তথা পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে চলেছে পদ্মার ইলিশ। যদিও চাহিদা অনুযায়ী যোগান কতটা থাকবে সেই বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া মৎস্যপ্রেমী বঙ্গবাসীর পকেটে সেই ইলিশ কতটা টান দেবে তা নিয়েও রয়েছে জল্পনা। তবে আশার কথা শনিবারের মধ্যে রাজ্যের প্রায় সব পাইকারি বাজারে মিলবে পদ্মার ইলিশ। হাওড়া, পাতিপুকুর, শিয়ালদা-সহ রাজ্যের প্রায় সমস্ত বাজারে ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্যের ‘ফিশ ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন’।
কিন্তু ইলিশ নিয়ে বাঙ্গালির এত আদিখ্যেতা কেন? আসলে ‘ইলিশ’ কেবল মাছ হিসাবেই নয় খাদ্য রসিক বাঙালির কাছে একটা আবেগ, একটা সুখকর অনুভূতি। কথায় আছে মাছে ভাতে বাঙালি আর সেই বাঙালির মাছেদের রানী বা রাজা হল ইলিশ। এটি এমন একটি মাছ যাকে ভাজা, ঝোল, সরষে বাটা, ভাপা থেকে শুরু করে আরও নানা রকম ভাবে খাওয়া যায়। যারা কাঁটার ভয়ে এই মাছটি খান না তারা যে কি আশ্চর্য স্বাদ থেকে বঞ্চিত হন তা বলে বোঝানো যাবে না। বর্ষার মরশুম বাঙালির কাছে ইলিশের আগমন ছাড়া প্রায় অসম্পূর্ণ।
ইলিশ মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Hilsha Hilsha বা Tenualosa Ilisha। এটি Clupeidae পরিবারের হেরিং প্রজাতির মাছ।এই মাছের সর্বাধিক প্রজননের হার দেখা যায় এপ্রিল মাসে, তবে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত নদীতে সব থেকে বেশি পরিমানে ইলিশ মেলে। কারণ এই সময়েই এদের বংশ বৃদ্ধি হয়। ইলিশ বাংলাদেশের মেঘনা-যমুনা, পদ্মা নদী এবং ভারতের গঙ্গা, রূপনারায়ণ, নর্মদা ও গোদাবরী নদীতেই বেশি পরিমানে পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, চিল্কা হ্রদ ইলিশ মাছ চাষের এক বিখ্যাত জায়গা। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় বছরই ইলিশের ঘাটতি হয়, তার পিছনে পরিবেশগত নানা কারণ থাকে। অনেক সময় খুব ছোট ইলিশ জাল ফেলে ধরা হয়। শুধু স্বাদের জন্যই এই মাছ বিখ্যাত নয়, এই মাছের পুষ্টিগুনও প্রচুর। ইলিশে ওমেগা ও তিন ধরণের ফ্যাটি আ্যসিড রয়েছে যা রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং মানবদেহের ইনসুলিন স্তরকে সুরক্ষিত রাখে। এছাড়া তৈলাক্ত মাছ হওয়ায় এটিকে অনেক কম তেলেই রান্না করা যায় ফলে মানবদেহে অতিরিক্ত তেল সঞ্চয়ের সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে যত রকম খাদ্যোপযোগী মাছ আছে তার মধ্যে ইলিশ সবথেকে জনপ্রিয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ; ২০১৭ সালে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রক এর আওতাধীন Department of Patents, Designs and Trademarks (DPDT) ইলিশ মাছকে বাংলাদেশের পণ্য হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রধানত বিশ্বের উৎপাদিত ইলিশের ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ বাংলাদেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় সর্বাধিক বিখ্যাত ইলিশ মাছ পাওয়া যায়, যা রপ্তানি করা হয়। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যেও ইলিশের উৎপাদন দেখা যায়। ইলিশ মাছের অন্যান্য নাম গুলি হল জাটকা, এলিস, পাল্লা মাছ, ইলীহ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। তামিল ভাষায় ইলিশ মাছকে উল্লামিন, অসমীয়া ভাষায় ইলীহি, গুজরাটি ভাষায় মোদার বা পালভা, ওড়িয়া ভাষায় ইলিশী ও তেলেগু ভাষায় পুলাসা নামে ডাকা হয়। ইরাকে এটি স্বুর, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এটি তেরুবক নামে পরিচিত। ইলিশ মাছ ইষৎ লোনা জলে জন্মায়, এটি ৩ কেজি ওজন পর্যন্ত ও দৈর্ঘ্যে ৬০ সেমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাঙালিরা বর্ষাকালে সব থেকে বেশি ইলিশ মাছ খেয়ে থাকে। যদিও এখন সারা বছর এই মাছ স্টোর করে রাখার জন্য বাজারে এর জোগান অব্যাহত থাকে। তবে বর্ষাকালে উৎপন্ন ইলিশের স্বাদ হয় আলাদা। খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা মনে হয় প্রতিটি বাঙালির বর্ষার মরশুমের প্রিয় খাদ্য। তবে এই মাছকে বাঙালিরা শুধু খিচুড়ির সাথেই আবদ্ধ রাখেনি।কখনও পান্তাভাতের সাথে ইলিশ মাছ ভাজা কিংবা গরম ভাতের সাথে মাছের তেল ও মাছ ভাজা মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। আবার কখনও সরষেবাটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে সরষে ইলিশ কিংবা নারকেল ও সরষে বাটা দিয়ে করা ইলিশ ভাপা বা পাতুরি কিংবা কালোজিরে দিয়ে ইলিশের তেলঝোল বা বেগুন আলু দিয়ে সাধারন ঝোল বাঙালির স্বাদের ভাগকে শতগুনে বৃদ্ধি করেছে।
অনেক বাঙালি হিন্দু পরিবারে সরস্বতী পুজো কিংবা লক্ষী পুজোর দিনে শিল্প বা জ্ঞান কিংবা আর্থিক সমৃদ্ধির জন্য একজোড়া ইলিশ মাছ এনে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। বাঙালির খাদ্য তালিকায় ইলিশের নামডাক থাকা সত্ত্বেও, এই নিয়ে বাঙাল ঘটির দ্বন্দ্ব চিরকালীন। কিন্তু আমার মতে ইলিশের মতো সুস্বাদু মাছ বাঙাল না ঘটির সেই দ্বন্দ্ব ভুলে একে সর্বজনীন ভেবে নিয়ে নিজেদের খাদ্য তালিকায় যোগ করাই শ্রেয়। তাই বলি এই বর্ষার মরশুমে বৃষ্টির সাথে সাথে ইলিশের স্বাদ মন ভরে উপভোগ করুন; ইলিশে থাকুন, ইলিশে বাঁচুন।