গত ৯ আগস্ট থেকে ৩১ আগস্ট; হিসাব অনুযায়ী ২২ দিন অতিক্রান্ত, এখনও আর জি কর হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের কিনারা হলনা। অথচ এই শহর কলকাতা, শহর পেরিয়ে প্রতিটি গ্রাম, প্রতিটি গঞ্জ এমনকি প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিটি কোনায় কোনায় শোনা যাচ্ছে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনি। সুবিচারসিহ নির্দিষ্ট কিছু দাবিতে জুনিয়র চিকিৎসকদের কর্মবিরতি চলছে। সাধারণ রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের ভোগান্তি বাড়ছে। যত দিন যাচ্ছে সমস্ত স্তরের মানুষ, স্কুল পড়ুয়া থেকে গৃহবধূ স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের পিচ রাস্তা থেকে মেঠো পথে প্রতিবাদ মিছিলে পা মেলাচ্ছেন। সবাই বিচারের দাবিতে আওয়াজ তুলছেন। নতুন নতুন গান, কবিতা, স্লোগানের সেই প্রতিবাদের স্বর কেবল এই রাজ্য নয়, দেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তে এমনকি সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে আছড়ে পড়েছে। একটি মর্মান্তিক এবং জঘন্য ঘটনার অভিঘাত যেমন নিস্তরঙ্গ নাগরিক জীবনকে বিচলিত ও অস্থির করে তুলেছে প্রতিক্ষণে, তেমনি শাসক তথা প্রশাসনের ভিতরকার দুর্নীতিকে বেআব্রু করে আসল চেহারাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
একটি সরকারি হাসপাতালের কর্মরত তরুণী চিকিৎসককে কেবল পৈশাচিকভাবে ধর্ষণ বা নৃশংসভাবে খুন নয়, তার দু’চোখে দেখা হাজারো স্বপ্নকে তাঁর কর্মস্থলের মধ্যেই ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। এমন কোন ভাষা আছে যা দিয়ে এর নিন্দা করা যায়, ধিক্কার দেওয়া যায়? গোটা দেশে সাম্প্রতিক অতীতেও এমন ঘটনার নজির খুঁজে পাওয়া যাবেনা। তাহলে একে আমরা কী নিছকই একটি অপরাধ বলবো? কেবল অপরাধী শনাক্ত করে কঠিন শাস্তির দাবী করবো? তবে তো এটা আর পাঁচটা অপরাধের মতো আরও একটি ঘটনা মাত্র। কিন্তু তা যে নয় তার প্রমাণ গোটা রাজ্য থেকে অন্যান্য রাজ্য, সমগ্র দেশ এমনকি বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষের ক্ষোভবিক্ষোভপ্রতিবাদপ্রতিরোধে জ্বলে ওঠা, জেগে ওঠা, দাবী আদায়ে সমুচ্চারিত স্বর। কারণ মানুষের কাছে এটা ভীষণ রকম অস্ত্বিত্বের প্রশ্ন, সংকটের প্রশ্ন, কেবলমাত্র কর্মক্ষেত্রে একজন মহিলার নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়। তার থেকেও বড় প্রশ্ন সমাজে কেন একজন মেয়ে অনিশ্চয়তা কিংবা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করবেন? একজন চিকিৎসকের যদি এই পরিণত হয় তাহলে এই সমাজে কে নিরাপদ? আমাদের শাসক বা প্রশাসন এতটাই ঠুনকো ও অথর্ব যে একজন মহিলা চিকিৎসককে তাঁর কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ!
আরজি কর হাসপাতালে ওই ঘটনার পর কলকাতা পুলিশের হাতে তদন্তভার ছিল পাঁচদিন। তারা দাবি করলো, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই অভিযুক্তকে তারা গ্রেপ্তার করেছে। মুখ্যমন্ত্রীও সংবাদমাধ্যমে যা জানালেন তার মানে হয় গোটা ঘটনা একজনই ঘটিয়েছে এবং সেই সিভিক পুলিশ গ্রেপ্তার। কিন্তু না, পুলিশের তদন্ত নিয়েই প্রশ্ন উঠলো আর সেই কারণেই কলকাতা পুলিশের সদর দফতর লালবাজারে পুলিশকে সাংবাদিক বৈঠক করে সাফাই দিতে হচ্ছে, আর সেখান থেকে উঠছে একটার পর একটা নতুন প্রশ্ন। আসলে সন্দেহ উসকে দিচ্ছে পুলিশ নিজেই। কারণ, খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় একজন অভিযুক্ত’র তত্ত্ব এবং চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই সেই সিভিক পুলিশকে হাসপাতাল চত্বর থেকেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ নিজেই নিজের অপরাধের জালে জড়িয়ে পড়েছে। মিথে ঢাকতে গিয়ে পুলিশ এমন এক গল্প ফাঁদল যে একজনি সেদিন ওই ঘটনা ঘটালো, একাই সে হাসপাতালে রাতে তিনবার ঢুকলো বেরোলো তারপর ধর্ষণ ও খুনের পরে সল্টলেকে চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের ব্যারাকে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল এবং পরের দিন ফের সে হাসপাতাল চত্বরেই এসে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল। এবং একটা হেডফোন সহ রহস্য সমাধান করে দিল!
যাদের উপর নাগরিকদের সুরক্ষাভার সে পুলিশের বিরুদ্ধেই তথ্য প্রমাণ লোপাটের গুরুতর অভিযোগ। ঘটনাস্থল ঘিরে রাখা নেই। সেমিনার রুমে একাধিক বহিরাগতের ভিড় অথচ পুলিশ বারংবার লালবাজারে বসে দাবি করে, ৫১ ফুটের সেমিনার রুম, ৪০ ফিট পর্যন্ত কর্ডন করা ছিল। ৪০ ফিটের বাইরে ১১ ফিট এলাকায় অনেক মানুষ ছিলেন! এরকম হালকা কথা সংবেদনশীল ঘটনার তদন্তে কি বলা যায়? সিবিআই’র দাবি, ক্রাইম স্পট নষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয় সুপ্রিম কোর্টে আর জি কর মামলার শুনানি চলার সময়ে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় রাজ্যকে প্রশ্ন করেছিল, ৯ তারিখ সকাল ১০টা ১০-এ ঘটনার জেনারেল ডায়েরি করা হয়েছে। এর পরে ক্রাইম সিন সিল করা হয়েছে রাত ১১টার পরে, এতক্ষণ কী হচ্ছিল?’ অর্থাৎ ক্রাইম স্পট সিল বা কর্ডন করার কথা সকালে কিন্তু করা হয় রাত এগারোটার পরে। স্বভাবতই গোটা ঘটনায় প্রথম থেকেই কলকাতা পুলিশের আচরণ ও তদন্ত প্রক্রিয়া গুরুতর সন্দেহের মুখে।
কেন কলকাতা পুলিশের উচ্চ পদস্থ আধিকারিক ঘটনার পরে বাড়িতে গিয়ে মৃতার বাবা-মাকে টাকার বিনিময়ে গোটা ঘটনা মিটিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল? এমনকি যখন পরিবারের সদস্যদের কাছে টাকার ‘অফার’ দিয়েছে পুলিশ সেই সময় তাঁদের মেয়ের শেষকৃত্য পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি! তার মানে বিচার কেবল মহিলা চিকিৎসকের খুনীর নয় যারা খুন-ধর্ষণ চক্রে জড়িত, যারা আড়াল করছে অপরাধীকে, তথ্য প্রমাণ লোপাট করেছে প্রত্যেকের বিচার। কিন্তু ২২ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরও সেই বিচারের আলো দেখা যাচ্ছে না।