সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে এই অভিযোগ এনে সানোজ মিশ্রের ছবি ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করা হয়েছিল।কিন্তু ছবির মুক্তিতে হস্তক্ষেপ করতে নারাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ।হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির মত, ‘সিনেমা বা বই নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে। ইচ্ছে হলে দেখুন, না হলে দেখবেন না, কেউ কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে না। গণতান্ত্রিক দেশে এটা স্বাভাবিক, সমালোচনার অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে। এ সমস্ত বাদ দিয়ে অনেক সিরিয়াস ইস্যু রয়েছে। এ রাজ্যের মানুষ অনেক সহনশীল, তাঁদের বিচার বিবেচনার উপর ছেড়ে দিন’, এই মন্তব্যও করেন প্রধান বিচারপতি।
প্রসঙ্গত, ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ছবিটির ট্রেলার ইউটিউবে মুক্তি পাওয়ার পর থেকেই বিতর্কের শুরু। ততদিনে ট্রেলারটি দেখেন সাড়ে চার লক্ষ মানুষ। ৪০ হাজার জন ভিডিয়োটি পছন্দও করেছেন। ছবিটির বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে কলকাতার আমহার্স্ট স্ট্রিট থানায়। বাংলাকে বদনাম করাই ছবির উদ্দেশ্য বলে তাতে দাবি করেন অভিযোগকারী। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই ছবির পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হয়।‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ছবিটির বিষয়বস্তুর সত্যতা যাচাই করতেই পরিচালক সনোজকে ডেকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়। যদিও পরিচালকের দাবি, তাঁকে হেনস্থা করাই আসল উদ্দেশ্য। তাই তলব করা হয়েছে পুলিশের তরফে। পরিচালক বলেন, “বাংলায় যে উৎপাত রয়েছে, তার উপর নির্ভর করেই ছবি। বাংলায় সামাজিক অসাম্য, বেকারত্ব, মানুষের যন্ত্রণা, তুষ্টিকরণের রাজনীতি নিয়েই ছবি করছি আমরা। ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, কী ভাবে মানুষ সরকারকে পাশে পান না, তাই ফুটিয়ে তুলেছি আমরা। বিচারব্যবস্থার উপর আস্থা রয়েছে আমার। কিন্তু আইনের অপব্যবহার হওয়া উচিত নয়। আসলে সত্যের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা চলছে”।
‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ছবির শ্যুটিং ৬০ শতাংশ সেরে ফেলার পর ছবির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছিল। তাতে বাংলাকে ‘দ্বিতীয় কাশ্মীর’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সরাসরি ছবিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিশানা করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ‘জনসংখ্যায় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে, শরিয়ৎ আইনই চলবে’, এমনও উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার চলছে, তাঁদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তার পরও রাজ্যের সরকার একটি সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করছে না বলে উল্লেখ রয়েছ ট্রেলারে। ছবি ঘটনাবলীকে সত্য ঘটনা নির্ভর বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর ছবির পরিচালক সনোজ মিশ্রকে নিয়ে চলে আলোচনা। শোনা যাচ্ছিল তাঁকে খুঁদে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ৮ দিন নিখোঁজ থাকার পর বারাণসীতে খোঁজ মেলে বিতর্কিত এই ছবির পরিচালকের। পুলিশ সূত্রে খবর, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের জেরার মুখোমুখি হওয়ার পরই নাকি তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে সনোজ মিশ্রর খোঁজ পাওয়া যায় বারাণসীর অসসি ঘাটে। পরিবারের হাতে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়েছে বলেও পুলিশ সূত্রে খবর।
স্বভাবতই প্রশ্ন এসে পড়ে কী আছে ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর ট্রেলারে বিশেষ করে ছবিতে? কেন তা নিয়ে এত বিতর্ক? সত্যিই কি এতে রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে? হিন্দি ভাষায় তৈরি ছবি ‘দ্য ডায়েরি অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল’ ছবির ট্রেলারের দৈর্ঘ্য ২ মিনিট ১২ সেকেন্ড। ট্রেলারের শুরুতেই সংখ্যালঘুদের প্রতি তোষণের চিরাচরিত রাজনীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন পরিচালক। বাংলায় সিএএ, এনআরসি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবির ট্রেলারেও তাঁর সেই বক্তৃতা দেখানো হয়েছে। মমতার চরিত্রে অবশ্য অভিনয় করেছেন অন্য কেউ। এই ছবিতে মূলত বার্তা দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি সম্প্রদায়কে ‘তোষণ’ নীতির বিরুদ্ধে। অভিযোগ, সংখ্যালঘুদের সুবিধার্থে সরকারের একের পর এক নীতি সমস্যায় ফেলেছে অন্য সম্প্রদায়কে। বাংলাকে ‘দ্বিতীয় কাশ্মীর’ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে এই ছবিতে। ট্রেলারে শোনা গিয়েছে মমতার নাম এবং বহুল প্রচলিত ‘খেলা হবে’ স্লোগান। দুর্গাপুজোর বিসর্জন মহরমের পর হবে বলে যে নির্দেশ এক বার দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী, তা-ও ট্রেলারে দেখিয়ে ‘তোষণ’-এর ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ছবির নির্মাতা দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গারা কাঁটাতার পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছেন। এর ফলে এ পারের একটি সম্প্রদায়ের মানুষ হচ্ছেন ঘরছাড়া। ওই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে কোনও রকম হিংসায় কোনও ব্যবস্থা সরকার নেয়নি বলেও অভিযোগ।
ছবির ট্রেলারে একের পর এক ইস্যু তুলে ধরে বাংলায় অশান্তি এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি দেখিয়েছেন পরিচালক। অনেকেই যা ভাল চোখে দেখছেন না।এই ছবির বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তৃণমূল। রাজ্য বিজেপির দাবি, ‘‘বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলা থেকে জঙ্গি ধরা পড়ছে। এই বাস্তবতাকে কেউ যদি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরতে চান, সেটা তো সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য। সেটা কতটা সত্য, কতটা আংশিক সত্য, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সিনেমাকে নিষিদ্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত চরম অগণতান্ত্রিক, অসহিষ্ণু এবং স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার প্রকাশ।’’ ছবির পরিচালক সানোজের কথায়, ‘‘রাজ্যের ভাবমূর্তি নষ্ট করা কখনওই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। গবেষণা ও অনুসন্ধান করে পাওয়া তথ্যই ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে।’’ কিন্তু তাতেও বিতর্ক থামছে না।