ধর্ষকের একমাত্র শাস্তি ফাঁসি। এ কথাই মনে করেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্য়ায়। আর সে কারণেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের সমাবেশে তিনি বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে ধর্ষণ-বিরোধী আইন পাশ করিয়ে নেবেন বলে জানান এবং এই কাজ আগামী ১০ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ করবেন বলে তিনি ঘোষণা করেন। তিনি জানান, স্পিকারকে বলে তিনি আগামী সপ্তাহেই বিধানসভার অধিবেশন ডাকবেন। তারপর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা থেকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে ধর্ষকের ফাঁসির বিল পাশ করে রাজ্যপালের কাছে পাঠাবেন। সেইসঙ্গে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েও বলেন যে রাজ্যপাল যদি সেই বিলে স্বাক্ষর না করেন, তাহলে রাজভবনে গিয়ে ধরনায় বসবেন।
প্রসঙ্গত, মমতা জানান, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে দ্রুত ধর্ষণ-বিরোধী আইন প্রণয়ন করার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাতে ভ্রূক্ষেপ করা হয়নি। রাজ্যের হাতে ক্ষমতা থাকলে সাতদিনের মধ্যে সেই আইন প্রণয়ন করে ফেলতেন। তাঁর মতে, ধর্ষকদের একমাত্র শাস্তি হল ফাঁসি। অন্য কোনো শাস্তি নয়। এই একটা কাজ করলেই সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাবে, দুর্বৃত্তরা ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে দাবি করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে, সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। রাজ্য সরকার চেয়েছিল যে ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে সাতদিনের ব্যবস্থা করা হোক। সেইসঙ্গে কামদুনির ধর্ষণ কাণ্ড নিয়ে মমতা জানান যে রাজ্য সরকার ফাঁসি চেয়েছিল ধর্ষকদের। তবে আদালতের রায়ে দু’জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।
ধর্ষণের মতো পাশবিক ঘটনার বিচারের জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে চায় রাজ্য। ৩ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় বিল পেশ করা হবে। বিলের খসড়া তৈরির জন্যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই মোতাবেক কাজও শুরু করে দিয়েছেন মুখ্যসচিব ও আইনমন্ত্রী মলয় ঘটক। প্রশ্ন, বিলের বিষয়বস্তু কী? রাজ্যে কোনো ধর্ষণ বা ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা ঘটলে দোষীর দ্রুত চরমতম শাস্তির কথা থাকবে বিলে। এই বিষয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের পক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে, সেপ্টেম্বরের বিধানসভায় ২ ও ৩ তারিখ বিশেষ অধিবেশন বসবে। ৩ তারিখ বিলটি বিধানসভায় পেশ হবে। আর জি করের কেসটা পুলিশের কাছ থেকে সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। সিবিআই অনেক সময় লাগাচ্ছে। তাই মুখ্যমন্ত্রী এই বিল আনতে চাইছেন। যাতে কোনও মহিলার উপর অত্যাচার হলে দোষীর যাতে দ্রুত সাজা হয়। আর জি কর কাণ্ড নিয়ে তোলপাড় বাংলা। সবমহল থেকে দোষীর শাস্তির দাবি উঠছে। জানা গিয়েছে বিধানসভায় ধর্ষণ বিরোধী বিল আনার প্রস্তাবে মন্ত্রিসভা সবুজ সংকেত দিয়েছে। তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় দিকে দিকে যে প্রতিবাদ আন্দোলন তা গোটা সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। ফুঁসে উঠে গোটা বাংলা, সবার মুখেই একটাই দাবি— ‘বিচার চাই… বিচার চাই।’
তবে সময়সীমা বেঁধে বিচার এবং শাস্তি হিসাবে একমাত্র ফাঁসি নিয়ে আইনজ্ঞদের অনেকেই দ্বিধায় বিশেষ করে বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে। অনেকেই দ্রুত বিচারের নামে সময় বেঁধে দেওয়ার লক্ষের মধ্যেও অশনি সঙ্কেত দেখছেন। এক সময়ে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৭২ ধারায় (খাদ্যে ভেজাল দেওয়া) দোষ প্রমাণিত হলে এ রাজ্যে সাজা ছিল ৬ মাস জেল। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ওই অপরাধে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়। উত্তরপ্রদেশে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৩৮ ধারার (আগাম জামিন) ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল। পরে সেখানে সেই ধারা চালু হয়। কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এই দু’টি উদাহরণ সামনে এনে জানান, যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ তালিকাভুক্ত, তাই এ রাজ্যের সরকার ধর্ষণের ক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যে সর্ব্বোচ্চ সাজা হিসেবে সুপারিশ করতেই পারে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা সংসদ হয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন সাপেক্ষ। পাশাপাশি একাধিক আইনজীবীদের প্রশ্ন, ধর্ষিতার বয়স ১২ বছরের নীচে হলে, আর ১৮ বছরের কমবয়সি গণধর্ষিতা হলে ফাঁসির বিধান রয়েছে। ফলে, যে কোনও বয়সের নারীই ধর্ষিতা হলে সব ক্ষেত্রেই অভিযুক্তর সাজা ফাঁসি দেওয়ার বিধান কি যুক্তিতে টিঁকবে? তাদের বক্তব্য, এক সময়ে ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে ৩০৩ ধারা ছিল। কিন্তু সেটা (মিঠু সিং ভার্সেস পাজ্ঞাব, ১৯৮৩) অসাংবিধানিক বলে বাতিল হয়। কারণ, কোনো অপরাধের শাস্তি একমাত্র ফাঁসি— সেটা হতে পারে না। তাছাড়া অপরাধের গভীরতার সঙ্গে শাস্তির মাত্রা যদি সমানুপাতিক না-হয়, তা হলে তা কেমন শাস্তি? ধর্ষণ ও খুনের যা শাস্তি, শুধু ধর্ষণের ক্ষেত্রেও এক সাজা? এটা কেমন বিধান? আইনজীবীদের অনেকেই বলছেন, সময় বেঁধে বিচার যদি বাধ্যতামূলক হয়, তা হলেও তার ফল উল্টো হওয়ার সম্ভবনা প্রবল।