আর জি কর মেডিক্যাঅল কলেজের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ন্যায় বিচার দাবী করে প্রতিদিন প্রতিবাদের ঢল নামছে। সমস্ত স্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে শান্তিপূর্ণ পথে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন এবং মেয়েদের নিশ্চিত নিরাপত্তার দাবিতে ফুঁসছে গোটা রাজ্য। আমরা অনেকে বিশ্বাস করতে শিখেছিলাম, যে আজকের প্রজন্ম মোবাইল ফোনে আর কেরিয়ার তৈরিতেই বুঁদ হয়ে আছে কিন্তু দেখা গেল, তারাই হয়ে উঠেছে আন্দোলনের মুখ। টেলিভিশন ধারাবাহিকে শ্বাশুড়ি বৌমার দ্বন্দ্ব ধন্দের গল্প কাহিনি থেকে মুখ ফিরিয়েও বহু মহিলারা প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। মানুষ স্বাধীনতা দিবস বা রাখীবন্ধনের মতো উৎসবকেও প্রতিবাদের মঞ্চ গড়ে তুলেছেন। যে কারণে এবার বিগত বছরগুলির মতো ১৪ অগাস্ট মধ্যরাতে শব্দবাজির তাণ্ডব কিংবা সকাল থেকে মাইকে দেশাত্মবোধক গানের শব্দদুষণে কান ঝালাপালা হয়নি। বরং ১৫ অগাস্টের উৎসবের আমেজে অনেকখানি ভাটা পড়েছিল। কেউ তো এবার এসব করতে বারণ করেনি অথচ কোথাও যেন একটা বিষাদ এবং প্রতিবাদের পরিবেশ গড়ে উঠেছিল। রাখীবন্ধন উৎসবেও আমরা দেখলাম কেবল শহর নয়, অসংখ্য গ্রাম গঞ্জের মানুষও তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদ করতে এই সামাজিক উৎসবকে বেছে নিয়েছিলেন। বহু জায়গাযতেই কালো রঙের রাখী অথবা সুবিচারের দাবি জানিয়ে একে অন্যকে রাখী পরিয়ে দিয়েছেন, নাগরিক উদ্যোগে সংগঠিত হয়েছে মিছিল।
এইসব দেখে শুনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, এর আগেও রাজ্যে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে খুনের ঘটনা ঘটেছে, একটি দুটি নয়, একাধিক, তখন মানুষ যে কোনো প্রতিবাদ করেনি, সেকথা বলা যাবেনা, কিন্তু মানুষ কী ঠিক এই ভাবে প্রতিবাদে করেছিল বা মিছিল জমায়েত সংগঠিত হয়েছিল? আসলে আন্দোলন বা প্রতিবাদ দানা বাঁধার পিছনে অনেক শর্ত, নানা রকমের পরিবেশ পরিস্থিতি কাজ করে। কলকাতা বা তার আশপাশের অঞ্চলের ঘটনা যতটা প্রচার পায়, দূরের গ্রাম গঞ্জের ঘটনা সেভাবে পায় না। উল্লেখ্য, ১৪ অগাস্ট রাতে যখন সারা কলকাতা, সারা বাংলার মেয়েরা জনজোয়ারে বদলে দিয়েছিল রাতের ছবি। তিন জায়গায় জমায়েত হওয়ার কথা, তা হল শত শত জায়গায়। লক্ষ লক্ষ মেয়ের সঙ্গে পথে নামলেন কিশোরকিশোরী, পুরুষরাও। ঠিক সেই রাতেই পূর্ব বর্ধমানে এক আদিবাসী মহিলা খুন হন কিন্তু ততটা গুরুত্ব পায়নি সেই ঘটনা। তবে সেদিন এবং তার পরেও আন্দোলনে অনেক জায়গাতেই পূর্ব বর্ধমানের আদিবাসী মহিলার হত্যাকারীদের দ্রুত শাস্তির দাবি ওঠে। পাশাপাশি বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাও এই আন্দোলনে অনুঘটকের কাজ করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। কেউ বলছেন, আন্দোলনের মধ্যে আভিজাত্যের উপাদান যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে যে কোনো ধরণের সংগঠন বা সোশাল মিডিয়ায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে যে ছাত্রছাত্রীরা বা মানুষেরা আন্দোলন কর্মসূচি ঠিক করছেন অথবা কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছেন, অন্যদিকে যে সমস্ত গৃহবধূরা বা মেয়েরা, পুরুষেরা ঘর-বাড়ির ঘেরাটোপ ছেড়ে রাস্তায় নামছেন, তাঁদের ওসব ভাবতে বয়েই গেছে। বরং আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ-খুনের ন্যায় বিচার আন্দোলন আরও অনেক ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন মেয়েদের কাজের জায়গায় বা বাড়ির বাইরে নিরাপত্তা, শ্রমজীবী মহিলাদের অধিকারের মতো নানা সমস্যার কথা সামনে আসছে। এই সামাজিক ব্যাধিগুলিকে মানুষ আজ নিজের বিপদ বলে ভাবছেন। একটি নৃশংস ঘটনার কারণেই প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠত হয়নি বা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে নানা অসঙ্গতি, অনাচার, দুর্নীতি ঘিরে যে ক্ষোভ জমতে থাকে, নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হতে থাকে, জীবন অনিশ্চয়তায় ভরে ওঠে, তার থেকেই একদিন এই ভাবে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে মানুষ, সেই গর্জন প্রতিরোধে রূপান্তরিত হয়। অন্ধকার রাস্তায় বাড়ি ফিরতে গিয়ে উদ্বিগ্ন মেয়েটির অসহায়তা, কন্যা সন্তানের বাবা-মার সঙ্গে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক, সেবিকা ও ছাত্রছাত্রীর নিরাপত্তাহীনতা মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
তবে হ্যাঁ আরজি কর মেডিক্যাল হাসপাতালের ঘটনাটি অবশ্যই একটি তাৎপর্য বহন করে। কারণ, হাসপাতালটি বা তার আশপাশ কামদুনির মতো গ্রামাঞ্চল নয়, যেখানে কলেজ থেকে ফেরার পথ থাকে জনহীন, গা ছমছমে। তেহট্টও নয়, যেখানে ধর্ষণের পর স্থানীয় প্রভাবশালীদের নির্দেশে দেহ দাহ করে দেওয়া হয় স্বীকৃতিহীন শ্মশানে। আরজি কর তো কলকাতা, যেখানে দিনরাত গমগম করছে মানুষের ব্যস্ততায়, তাছাড়া সরকারি হাসপাতাল, মানুষের চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মীদের কাজের জায়গা সেটি। সেখানে মানুষের চিকিৎসার বদলে একজন ডাক্তার ধর্ষণ ও খুন হয়ে যাওয়া তো নির্ভয়া কাণ্ডের চেয়েও অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। তার মানে অপরাধী বা তাদের মন প্রশাসনের প্রশ্রয়ে একশো ভাগ নিশ্চিন্তে ছিল। অপরাধীদের ওই নিশ্চিন্ততা যে আমাদের পক্ষে কী ভীষণ অনিশচয় এবং নিরাপত্তাহীনতা তা আমরা হাড়েহাড়ে বুঝতে পারলাম। শাসক তথা প্রশাসন অপরাধীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং নিজেদের সুরক্ষার ভীত পাকাপোক্ত করতে যত জোর দিয়েই চুপ রহো বলে উঠুক না কেন আমরা বুঝলাম এই ঘটনার বীভৎসতার সঙ্গে বিপদের নৈকট্যে আমাদের ঘাড়ের কাছে আততায়ী নিঃশ্বাস ফেলছে। বিপদ কেবল নারীর সুরক্ষায় আটকে নেই। এটা খুব স্পষ্ট যে, সাধারণ জীবন নিয়ে রাষ্ট্র বা সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই। বরং তারা দুর্নীতিকে নীতি, অন্যায়কে ন্যায় এবং চুরিজোচ্চুরিচিটিংবাজিকে একমাত্র পথ হিসাবে প্রতিষ্টা দিতে ব্যাস্ত। তাই সজোরে এবং সপাটে এমন ধাক্কা দিতে হবে যাতে টুকরোগুলি আর কোনোভাবে জোড়া না লাগে। তা নাহলে গোটা রাজ্যটাই তো একদিন আরজি করের সেমিনার রুম হয়ে যাবে।