আরজি কর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসক ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার পর যেভাবে প্রতিবাদ আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে তা এই বাংলায় বিগত কয়েক দশকের মধ্যে দেখা যায়নি। স্বাধীনতা দিবসের রাতকে যেভাবে মেয়েরা জাগিয়ে দিয়েছিলেন প্রতিবাদের সেই তরঙ্গ বঙ্গভঙ্গ বা ইংরেজ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের পর যে আর দেখা যায়নি সেকথাও নির্ধিদায় বলা যায়। মেয়েরা সেদিন কেবল পথে নামেন নি, তারা সবাই প্রকাশ্যে তাদের মত প্রকাশ করেছেন, সমাজের সামনে প্রশ্ন তুলেছেন। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও সমস্বরে সুবিচারের দাবী করছেন, দোষীর শাস্তি চাইছেন, শাসক প্রধানের পদত্যাগ চাইছেন, সেইসঙ্গে ঘটনায় জড়িত সমস্ত স্তরের অভিযুক্তদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি দেওয়ার দাবী করছেন। বিচারে কঠোর শাস্তি হওয়াটা যে দরকার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। কিন্তু বিচারের পক্রিয়া কী আজ পর্যন্ত এক ধাপও এগিয়েছে? কার্যত তা এগোয়নি। আন্দোলনের চাপে মেয়েদের নিরাপত্তা রক্ষায় আরও বেশি সংখ্যক পুলিশি ব্যবস্থা, আরও বেশি বেশি সিসিটিভি-র নজরদারি এবং পুলিশ কমিশনারের কথা অনুযায়ী, নারী-হিংসার প্রতি পুলিশ ‘জিরো টলারেন্স’ নিয়ে চলবে- এমনটাই বলা হচ্ছে। ওদিকে বিচার পর্বে দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্নবাণ তুলছে ঠিকই কিন্তু সময় তো দ্রুত বয়ে যাচ্ছে। প্রশ্ন জাগছে মহামান্য আদালত কী বাবা বাছা বলে আন্দোলনের ধার ভোঁতা করতে চাইছেন নাকি জুনিয়র ডাক্তারদের কর্মবিরতি তুলে দিয়ে রাজ্য সরকারের অস্বস্তি কমাতে চাইছেন? আসল বিষয় তো ‘তিলোত্তমা’ বা ‘অভয়া’র ধর্ষণ ও হত্যার বিচার ও অভিযুক্তদের শাস্তি, আশার কোনো আলো তো দেখা যাচ্ছে না।
একথা হাজার ভাগ সত্য, মেয়েরা যাতে নির্ভয়ে অবাধে চলাফেরা করতে পারে, কাজের জায়গায় কাজ করতে পারেন, তার জন্য নিরাপত্তা সব ক্ষেত্রেই জোরদার হওয়া দরকার। কোনও একজন মেয়ে বিপদে পড়ে ডাকলেই যাতে কাছাকাছি কোনও পুলিশের সহায়তা পেতে পারেন তার ব্যবস্থা হওয়াটাও খুব জরুরি। তার জন্য পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো এবং সর্বত্র সিসি ক্যামেরার নজরদারি দরকার। কারণ, কোনও অপরাধ ঘটলে তার তদন্তে পুলিশ এবং ক্যামেরা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা নিতে পারে। তার মানে মেয়েদের উপর আক্রমণ হবেই, বিপদ ঘটবেই এটা আজ ধরে নিতে হচ্ছে। প্রশ্ন, পুলিশের সংখ্যা আরও বাড়িয়ে এবং চারপাশে আরও বেশি সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে সত্যি কি মেয়েদের উপর ক্রমাগত বাড়তে থাকা আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে অথবা কমানো যাবে? মেয়েদের নিগ্রহ কিংবা ধর্ষণ-হত্যার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কড়া আইন দিয়ে, অপরাধীকে কঠিন শাস্তি দিয়ে কী এই অপরাধ রোখা যাবে? উল্লেখ্য, নির্ভয়া কাণ্ডের পরে প্রবল গণবিক্ষোভের চাপে ধর্ষণ-খুন সংক্রান্ত আইন বদলানো হয়, সাজা আগের তুলনায় অনেক কঠোর হয়। দেখা যাক ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য কী বলছে? বলছে, ২০১৮ সালে প্রতি ১৫ মিনিটে দেশে একজন মহিলা ধর্ষিতা হয়েছেন। ওই তথ্যই জানাচ্ছে, ২০২২ সালেও প্রতি ১৫ মিনিটে ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা একটিও একটিও কমেনি।
তার মানে এটা বুঝতে হবে সংখ্যায় পুলিশ যতই বাড়ানো হোক, প্রকাশ্যে আড়ালে সিসি ক্যামেরা যতই বাড়ানো হোক, আইনকে যত কঠিন কঠোর করা হোক, মেয়েদের উপর অত্যাচার বা ধর্ষণ-খুনের সংখ্যাটা অনেক বেশি এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কেবল তথ্যেই নয় বাস্তবিকই বাড়ছে এবং সেই ক্রমবৃদ্ধির গতি এতটাই দ্রুত যে তার সঙ্গে পেরে উঠতে ব্যার্থ হচ্ছে যে কোনো রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সাধারণ মানুষকে এটা আজ বুঝতে হবে কেবল আইন কঠোর করে, আরও পুলিশ বাড়িয়ে, চারিদিকে সিসি ক্যামেরার নজরদারি বাড়িয়ে নিরাপত্তাবলয় তৈরি করা গেলেও মেয়েদের উপর নির্যাতন কমানো যাবেনা অপরাধ মোকাবিলাও করা যাবেনা। সাধারণ মানুষ তো তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝেছেন, আমাদের পুলিশ ব্যবস্থা ও প্রশাসনে্র রন্ধ্রে দুর্নীতি কৃমি কীটের মতো কিলবিল করছে। কেবল কী তাই, পুলিশকর্তারা ক্ষমতাসীন দলের অনুগত সেবক হিসাবে কাজ করতে করতে নিজেদের দলদাসে পরিণত করেছে। দীর্ঘ যুগের কালের অভ্যাসে পুলিশের পক্ষে আর পক্ষে যেমন স্বাধীন ভাবেও নয় তেমনি নিজের বিবেক দিয়েও কাজ করা সম্ভব নয়। বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই, আরজিকর হাসপাতালের ঘটনার পুলিশি তদন্ত তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। চূড়ান্ত দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক তথা দলগুলি আজ রাজনীতির যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েই চলেছে তাতে এটাই দেখা যাচ্ছে যে এই সমাজের যত ধর্ষক-খুনি তাদের অধিকাংশই সেইসব দলের ছত্রছায়ায় লালিত পালিত। সাধারণ মানুষকে ত্রাসে রাখা থেকে শুরু করে ভোট লুট এই সব কাজেই শাসকদল তাদের ব্যবহার করে তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাসকদল তাদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তাদের অপরাধ আড়াল করতেই ব্যস্ত থাকে। তা সে যে রাজ্যের যে সরকারই হোক, পার্কস্ট্রিট, কাটোয়া, কামদুনি, ধূপগুড়ি, মধ্যমগ্রামের সরকার হোক অথবা উন্নাও, হাথরস, কাঠুয়ার সরকারই হোক বা তার আগের সরকারই হোক।পুলিশ নিজেই তো বহু রাজ্যে নানা অপরাধে অভিযুক্ত, এমনকি ধর্ষক, নারী নির্যাতনকারীদের আড়াল করার জন্য। পাশাপাশি এই প্রশ্নও এসে পড়ছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত দায়িত্ব নেওয়ার পরে এক সপ্তাহের বেশি কেটে গেলেও তদন্ত কত দূর এগিয়েছে, তা প্রকাশ্যে এল না। কেবল প্রশ্ন আর প্রশ্ন তাতেই কি আমরা মুগ্ধ হব?
যে কোনো মূল্যে সুবিচার পেতেই হবে, দোষীদের শাস্তি দিতে হবে, এই দাবী থেকে একচুল সরে আসা যাবে না। পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো, কোনায় কোণায় সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি কথায় চিড়ে ভিজবে না। কিন্তু ভুললে চলবে না শুধু আইন দিয়ে, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে এই অপরাধ কমানো যাবেনা। এটি সমাজের একটি গভীর অসুখ, মানসিকতা– এই অসুখ কঠর আইন করেও বদলানো যাবেনা। এই বিষয়ে তলিয়ে ভাবতে হবে আন্দোলনকারীদের। এই ভাবনার দায় তাঁদের, ভোটের রাজনীতি করা দল বা কর্মী-নেতাদের নয়। স্বভাবতই তারা আন্দোলনে সামিল আছেন কেবলমাত্র ভোটের ফায়দা তুলতেই। তারা ভোট ছেড়ে সমাজ ব্যবস্থা, মনন বা মানসিকতা বদলের কথা ভাববেন না। গভীর ভাবনা ভাবার দায় আন্দোলনকারীদেরই। দাবী যেমন আদায় করতে হবে, ভাবতেও হবে তলিয়ে। কারণ একদিন এই আন্দোলনের আগুনের আঁচ নিভে যাবে, ঝিমিয়ে পড়বে গতি, তীব্রতা। তারপর… ।