তৃণমূল জমানার গত ১৩ বছরে একাধিক ধর্ষণ-খুনের ঘটনা এক নিঃশ্বাসে উচ্চারণ করা যায় পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি, গেদে, গাইঘাটা, মধ্যমগ্রাম বা হাঁসখালির নাম। সেইসব ঘটনায় তৃণমূলের নেতাদের বক্তব্য তো বটেই, এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল অপরাধীকে আড়াল করার। সাধারণ মানুষের অভিযোগ ছিল, ধর্ষিতা বা নিগৃহীতার প্রতি যে সংবেদনশীলতা দেখানো উচিত, অপরাধীদের বিরুদ্ধে যে কঠোর মনোভাব দেখানো উচিত, তা মুখ্যমন্ত্রী তথা তাঁর প্রশাসনের তরফে দেখানো হয়নি। কিন্তু আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় গত কয়েকদিন ধরে যখন রাজ্য তোলপাড়, তখনও মুখ্যমন্ত্রীর অবস্থান নিয়েছেন অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। কিন্তু কেন? কাকে বাঁচাতে চাইছেন তিনি? কোন ঘটনাকে তিনি আড়াল করতে চাইছেন? অতীতে এবং এই মুহূর্তে তাঁর এই অবস্থান অত্যন্ত নিন্দনীয়।
কামদুনির ঘটনার পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা গ্রামের দুই প্রতিবাদী নারী মৌসুমি কয়াল এবং টুম্পা কয়ালের উদ্দেশে সিপিএম এবং মাওবাদী বলেছিলেন। একথা কী একজন মুখ্যমন্ত্রী বলতে পারেন? নাকি এই ধরণের কথা সাধারন মানুষের বিপুল ভোটে জিতে আসা একজন জাতীয় পর্যায়ের নেত্রীর মুখে মানায়? সেদিন কম হইচই হয়নি, পরে দেখা গিয়েছিল মৌসুমি-টুম্পারা প্রতিবাদের মুখ হয়ে উঠেছেন। কিন্তু আরজি কর হাসপাতালের ঘটনার পর গত কয়েক দিন ধরে যে প্রতিবাদ আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে তাকে মান্যতা না দিয়ে তিনি যেন তেন প্রকারেণ প্রতিরোধ করতে চাইছেন কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি ব্যর্থ, এমনকি তাঁর দলের পক্ষ থেকেও তিনি তেমন সমর্থন যে পাচ্ছেন না তা বুঝেও না বোঝার ভান করে চলেছেন।
ঘটনার দিন মুখ্যমন্ত্রী ঝাড়গ্রাম থেকেই কথা বলেন মৃতার বাবার সঙ্গে, ফেরার পথে একাধিক বার ফোন করেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলকে। পুলিশ সূত্রের খবর, কমিশনারকে মুখ্যমন্ত্রী বারংবার নির্দেশ দেন, ওই ঘটনায় যেন নজিরবিহীন দ্রুততায় তদন্ত শুরু করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়। তার পরেও মুখ্যমন্ত্রী নিজে বিষয়টি নিয়ে লাগাতার খোঁজখবর রাখতে শুরু করেন। তদন্তের প্রতিটি ধাপ যাতে তাঁকে জানানো হয়, সেই মর্মেও নির্দেশ দেন। তিনি তখনই প্রশাসনিক মহলে জানিয়েছিলেন যে, যথাসম্ভব দ্রুত তিনি নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে যাবেন। তারপরেই মুখ্যমন্ত্রী জানান, তাঁদের সরকারের উপর আস্থা না-থাকলে মৃতার পরিবারের লোকজন অন্য যে কোনও তদন্তকারী এজেন্সির কাছে যেতে পারেন। যেতে পারেন সিবিআইয়ের কাছেও। এ ধরনের কথার অর্থ কী? তাঁর নিজের সরকারের উপর মানুষেরআস্থা না থাকার কথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলছেন? গত ১৩ বছরে এমন আলগা বা বিবেচনাহীন কথা তো তিনি কখনো বলেননি। এই ধরনের কথাবার্তা এবং কার্যকলাপ বুঝিয়ে দিচ্ছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ত নিজের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন অথবা গত কয়েক বছর ধরে নিজের দলের লোকজন যেভাবে সমস্ত রকমের নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে বিরাট বিরাট কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে অভিযুক্ত তাতে তিনি আর পেরে উঠছেন না।
তাঁর নিজের দলের অন্দরেও আলোচনা শুরু হয়েছে, আগের মতো ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনায় ডাক্তার এবং পুলিশ জুড়ে যায়নি। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন এক ডাক্তার। মূল অভিযুক্ত হিসেবে যাঁকে ধরা হয়েছে, তিনি সিভিক ভলান্টিয়ার। ঘটনাচক্রে, এই দু’টি দফতরই রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে। তৃণমূলের অনেকে এ-ও বলছেন যে, বিষয়টি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মতো জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। মুখ্যমন্ত্রী যদি দৃঢ় মনোভাব দেখাতেন, সঠিক পদক্ষেপ নিতেন, ঘটনার আদ্যোপান্ত তদন্ত করতেন আগুনে এতটা ঘি পড়তো না। কিন্তু তা না করায় ঘটনার পর থেকে রাজ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর বিবেচনাহীন পদক্ষেপে সেই পরিষেবা পুরোপুরি ভেঙে পড়ার আশঙ্কায়। গত ১৪ আগস্ট, কলকাতা সহ জেলায় জেলায় ‘মেয়েরা রাতের দখল নাও’ শীর্ষক অভিযানের দিন বেহালায় প্রাক স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে আরজি কর কাণ্ডে বিরোধীদের লাগাতার আক্রমণ, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টকে কেন্দ্র করে আক্রমণ শানান মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরজি কর কাণ্ডে তদন্তের গতি প্রকৃতি নিয়ে কলকাতা পুলিশের কাজের প্রশংসা করে বলেন, মাত্র ১২ ঘন্টার মধ্যে দোষীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত এক মাসের সিসিটিভি পরীক্ষা করা হয়েছে। রাজ্যের তরফে দোষীর ফাঁসি চাওয়া হয়েছে। রবিবার অবধি সময় দিয়েছিলাম তার আগেই সিবিআইয়ের হাতে মামলার দায়ভার তুলে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তিনি ‘বাম-রামের’ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে দলীয় কর্মসূচী জানান মমতা। কেন তিনি এই ধরনের কথা বলছেন? ভয়ে, নাকি বেসামাল হয়ে পড়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী?
অথচ ফুটপাথে বেআইনি দখলদার উচ্ছেদে বুলডোজ়ার নামায় জনমানসের একাংশে যখন নেতিবাচক ধারনা তৈরি হচ্ছিল, তখন মুখ্যমন্ত্রীই তা থামিয়ে বলেছিলেন, কোনও মানুষকে বেকার করার অধিকার আমাদের নেই। সেই সূত্রেই শাসক শিবিরের একাংশ বলছেন, লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী পর্ব থেকে দেখা যাচ্ছে, মমতা নিজে শাসকের পাশাপাশি বিরোধী নেত্রীর ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয়েছেন। উত্তরবঙ্গে দলের নেতাকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। যেমন গ্রেফতার করা হয়েছে ভাঙড়ে তৃণমূলের দাপুটে নেতা আরাবুল ইসলামকে। কিন্তু সেই মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি সন্দীপ ঘোষকে ফের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ পদে বহাল করছেন! আরজি কর হাসপাতালের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘিরে তৃণমূলের অন্দরেও তোলপাড় শুরু হয়েছে। এই ঘটনায় গত সাত দিন প্রশাসন যে ভাবে এগিয়েছে, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহলেই চূড়ান্ত ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তাঁর ঘরের লোক অভিষেক বন্দ্যোপাধায় স্বয়ং। আরজি কর হাসপাতালের ঘটনায় রাজ্য সরকার উপযুক্ত পদক্ষেপ করতে ‘ব্যর্থ’ বলে মনে করছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। দলীয় সূত্রে খবর, সরকারের একের পর এক ‘ভুল’ পদক্ষেপ নিয়ে দলের অন্দরে চূড়ান্ত অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মনে করছেন, প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে ‘বদল’ ছাড়া দল ও সরকারের পক্ষে এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। কিন্তু টানা সরকার-বিরোধী আন্দোলনে কোণঠাসা হয়েও আক্রমণাত্মক অবস্থানেই রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। পুলিশ-প্রশাসনের পাশে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের পাল্টা আক্রমণ করছেন। বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও এই নিয়ে প্রতিবাদে প্রথম পথে নামেন দলের রাজ্যসভার সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায়। পথে নামলেও মমতা অবশ্য মিছিল করেছেন বিরোধীদের পাল্টা চাপে রাখতে চেয়ে। কিন্তু আরজি কর কাণ্ডে তা যে সহায়ক হবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে।