একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় অন্তত ২০ কেজির মতো প্লাস্টিক খায়! কথাটি চমকে ওঠার মতো হলেও প্রতিদিন খাবারে সঙ্গে যে পরিমাণ মাইক্রো প্লাস্টিক আমাদের দেহে প্রবেশ করে তাতে অমূলক মনে হয়না। মাইক্রোপ্লাস্টিক হল প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র টুকরো, যা অর্ধেক সেন্টিমিটারেরও কম। বেশিরভাগ অংশে প্লাস্টিক জৈব পদার্থের মতো পচে না, যদিও বড় টুকরোগুলি ছোট এবং ছোট টুকরোতে বিভক্ত হতে পারে। যেহেতু মানুষ প্রায় সত্তর বছর আগে বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিক তৈরি করা শুরু করেছিল, তাই আমাদের ঘরের প্রায় প্রতিটি কোণে জায়গা নিয়েছে যা কিছু তাতে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। তাছাড়া মাটি থেকে সমুদ্র এমনকি বাতাস থেকে খাদ্য শৃঙ্খলের মাধ্যমে আমরা আমাদের ফুসফুসে প্লাস্টিক নিঃশ্বাসে নিই। আমরা যে জল পান করি তাতেও রয়েছে প্লাস্টিক। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের (ডব্লিউডব্লিউএফ)-এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ প্রতি সপ্তাহে খাবারের সঙ্গে একটি ক্রেডিট কার্ডের সমপরিমাণ প্লাস্টিক গ্রহণ করে। সমুদ্রে প্লাস্টিক দুষণের ফলে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার ফলে প্লাস্টিক প্রবেশ করছে মানুষের দেহে, প্লাস্টিকের বোতল থেকে জল পান থেকেও। ক্রেডিট কার্ডের সমপরিমাণ মানে প্রায় ৭ গ্রাম প্লাস্টিক মানুষ খায় ১০ দিনে।
এক মাসেই মানুষের দেহে ৪x২ লেগো ব্রিকের সম্পরিমাণ প্লাস্টিক ও এক বছরে একটি হেলমেটের সমপরিমাণ প্লাস্টিক প্রবেশ করে। এ পরিমাণ খুব বেশি মনে না হলেও খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ ইত্যাদি বিভিন্ন অবস্থাভেদে পরিমাণ বাড়তেও পারে। এই হারে এক দশকে মানুষ দুটি প্লাস্টিক পাইপের সমপরিমাণ প্রায় আড়াই কেজি প্লাস্টিক খায়। এবং একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় অন্তত ২০ কেজির মতো প্লাস্টিক খায়! প্লাস্টিকের দাম কম হওয়ায় গত ৫০ বছরে বিশ্বজুড়ে হুহু করে প্লাস্টিকের উৎপাদন ও ব্যবহার বেড়েছে। প্লাস্টিক মাটিতে মিশে যায়না বা ধ্বংসও হয়না। এই কারণে প্লাস্টিক ছোট ছোট কণায় বিভক্ত হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে আমাদের আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সমুদ্রতল থেকে শুরু করে গহন অরণ্য এমনকি খাদ্যশৃঙ্খল– সর্বত্রই প্লাস্টিক ছড়িয়ে পড়েছে।
ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের সংরক্ষিত জলাভূমির উপকূলে দাঁড়িয়ে ইউনিভার্সিটি অব সাউদাম্পটনের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ম্যালকম হাডসন জলাভূমিকে জমে থাকা ছোট বিন্দুর মতো প্লাস্টিকের কণা দেখেছেন। হাডসনের মতে, বেশিরভাগ গবেষণা মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে হলেও, বর্তমানে এরচেয়েও ছোট ন্যানো প্লাস্টিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। ন্যানো প্লাস্টিক খালি চোখে দেখা যায়না, ফলে আমাদের দেহে ন্যানো প্লাস্টিক প্রবেশের সম্ভাবনা আরও বেশি থাকে। এই প্লাস্টিক কণাগুলো আমাদের রক্ত ও লসিকাতন্ত্রে প্রবেশ করে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গে থেকে যেতে পারে। এই প্লাস্টিক কণাগুলো টাইম বোমার মতো, যে কোনো মুহূর্তেই তা ভেঙ্গে মানুষ ও প্রাণীদেহে প্রবেশ করতে পারে। গবেষণা জানাচ্ছে মানুষ কয়েক টুকরো প্লাস্টিক স্ট্র’র সমপরিমাণ, ০.৭ গ্রাম প্লাস্টিক খায় একদিনেই। কয়েকটি প্লাস্টিকের বোতামের সমপরিমাণ প্রায় ৫ গ্রাম প্লাস্টিক খায় মানুষ এক সপ্তাহে। ২২ গ্রাম লেগো ব্রিকসের সমপরিমাণ প্লাস্টিক খায় মানুষ ১ মাসে। কয়েকটি প্লাস্টিক ক্যাপের সমপরিমাণ প্রায় ৬২ গ্রাম প্লাস্টিক খায় মানুষ ৩ মাসে। একটি হেলমেটের সমপরিমাণ প্রায় ২৪৮ গ্রাম প্লাস্টিক খায় মানুষ ১ বছরে।
প্রশ্ন, আমরা আমাদের দেহে কতটা উপাদান নিচ্ছি এবং স্বাস্থ্যের উপর তার প্রভাব কী? আমাদের খাদ্যের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করার বিভিন্ন ভেক্টর রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাছ, লবণ, মধু, চিনি, বিয়ার এবং পানীয় জল। আমরা যে মাছ, মাংস খাই তার থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলি আমাদের দেহের মধ্যে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যে লবণ ব্যবহার করি, প্রায়শই বাষ্পীভূত সমুদ্রের জল থেকে ধারণ করা হয়, তাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের খাদ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সবচেয়ে বড় উৎস পানীয় জল এবং এর বেশির ভাগই বোতলজাত জল থেকে আসে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সব একই আকারের নয়; তারা সব একই আকৃতি হয়না। উল্লেখ্য, আমাদের পরিবেশে কতটা মাইক্রোপ্লাস্টিক রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা খুব কমই, কিন্তু মাইক্রোপ্লাস্টিক খাওয়ার স্বাস্থ্যের প্রভাবের বিষয়ে আরও কম প্রকাশিত গবেষণা রয়েছে (যদিও এখন যথেষ্ট পরিমাণে কাজ চলছে)। একটি বড় প্রশ্ন এখনও ভালভাবে বোঝা যায় না তা হল আমরা যে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করি তার কতটা আমাদের মধ্য দিয়ে যায় এবং কতটা সহজভাবে জমা হয় বা অন্যান্য রাসায়নিকগুলিতে ভেঙে যায়, যার মধ্যে কিছু আমাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকারক হতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন যে প্লাস্টিক ক্যান্সার, জন্মগত অক্ষমতা এবং ফুসফুসের নানা রোগের কারণ। প্লাস্টিকের প্রভাবে শুধু মানুষই না, প্রতিটি জীবন্ত জিনিস, আমাদের পোষা প্রাণী থেকে আমাদের গাছপালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিজ্ঞানীরা এও বলছেন যে মাইক্রোপ্লাস্টিকমানুষের কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং মেরে ফেলতেও পারে। কোষের ক্ষতি কেন খারাপ? কোষের বিভিন্ন ধরনের কাজ আছে, তারা প্রধানত নিশ্চিত করে যে আমাদের শরীর সঠিকভাবে কাজ করছে। কোষের ক্ষতি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে এবং ক্যান্সারের সঙ্গে যুক্ত কোষের মিউটেশনের দিকে প্রভাবিত করতে পারে।