এবার কপ-২৯ বা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজারবাইজানের বাকুতে। আজারবাইজান এমন একটি দেশ, যার অর্থনীতি পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানী রপ্তানীর ওপর নির্ভরশীল। অথচ বলা হচ্ছে বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণায়নের জন্য প্রধানত দায়ী জীবাশ্ব জ্বালানী। কিন্তু দেখা গেল জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব পেল আজারবাইজান। বলা হচ্ছে রাশিয়ার ভূরাজনীতি ও লবিংয়ের ফলে এই সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব পেয়েছে আজারবাইজান। যে দেশের অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভর করে জীবাশ্ম জ্বলানি উত্তোলনের ওপর। সেই দেশে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্ব পাওয়ায় তীব্র সমালোচনা করেছেন গ্রেটা থুনবার্গ এবং বহু জলবায়ু কর্মী। সম্প্রতি গ্রেটা জানিয়েছেন, এটি ‘গ্রিনওয়াশ সম্মেলন’। কেবল তাই নয় যে সময় আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার মাত্র দিন দুয়েক আগেই সময়েই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জলবায়ু ফান্ড কমিয়ে দেওয়ার নীতির প্রধান উদ্যোক্তা। সব মিলিয়ে এই সম্মেলন ঘিরে শুরু হয়েছে নেতিবাচক চর্চা।
এবারের জলবায়ু সম্মেলন ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে আয়োজক দেশ আজারবাইজান নিয়ে কারণ, সে দেশটি পরিচালিত হয় একজন স্বৈরাচারী সরকারের মাধ্যমে। অন্যদিকে দেশটির অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি জীবাশ্ম জ্বালানীর ওপর নির্ভরশীল। জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় জলবায়ু সম্মেলন আয়োজিত হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমলারা কোথায় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে সে সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। এবারের আয়োজক দেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব রেখেছে রাশিয়া। সেই দেশটি নিজেও অনেকাংশে তেল বিক্রির ওপর নির্ভর করে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ বছর পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চলের কোনো দেশে এই সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল। তবে এ অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে কোন সদস্য দেশ কপ-২৯ আয়োজন করবে, তা নিয়ে কয়েক মাস ধরে বিতর্ক চলে। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভেটো দেয় রাশিয়া। যাদের বিরুদ্ধে ভেটো দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে বুলগেরিয়া, স্লোভেনিয়া ও মলদোভার মতো দেশ। এই দেশগুলো রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা করেছিল। স্বভাবতই সেইসব দেশকে আয়োজক হতে বাধা দেয় রাশিয়া। এর পর আয়োজক হিসেবে ছিল আর্মেনিয়া এবং আজারবাইজান। এই দুই দেশ আবার দশকের পর দশক ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে ছিল। অবশেষে আয়োজক দেশ হয় আজারবাইজান।
আজারবাইজান কপ-২৯ আয়োজনের জন্য এক বছরেরও কম সময় পেলেও সম্মেলন সফল করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাকুর কাছেই একটি স্টেডিয়ামে সাজানো হয়েছে কপ-২৯ এর ভেন্যু। এই শহরে ২০ থেকে ৩০ লাখ লোকের থাকার জায়গা পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো কাজটি করা হয়েছে তেল বিক্রির টাকা দিয়ে। তুলনামূলকভাবে ছোট শহরে হচ্ছে এই বড় আয়োজন। এই শহরে প্রতি বছর আয়োজন করা হয় ফর্মুলা ওয়ান গ্র্যান্ড প্রিক্স। যেখানে শহরের আশপাশের রাস্তাগুলোকে রেসট্র্যাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই স্টেডিয়ামের কাছেই তেল উত্তোলন খনি থেকে সারাক্ষণ তেল উত্তোলন করা হয়। এক মাইলেরও কম দূরের একটি তেল শোধনাগার প্রতিনিয়ত মিথেন পোড়ায়। মিথেন সবচেয়ে শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোর মধ্যে একটি। আজারবাইজানের কাসপিয়ান সাগরের তীরবর্তি অসংখ্য তেল খননের প্ল্যাটফর্ম সারাক্ষণ তেল তোলে। এই জীবাশ্ম জ্বালানির বেশিরভাগ অংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপের পশ্চিম অংশে পাঠানো হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপ নিজেদের ব্যাংকগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানির অর্থায়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। একই সময়ে ইউরোপে ব্যবহার হচ্ছে আজারবাইজানের গ্যাস। ইউরোপিয় ইউনিয়নের আশা, তাঁরা তেল গ্যাসে নিষেধাজ্ঞা দিলেও অন্যরা পাইপলাইন সম্প্রসারণে টাকা ঢালবে।
প্রতি বছরই জলবায়ু সম্মেলনে আর্থিক আলোচনা নিয়ে প্রচুর উত্তেজনা, আলাপ বা সমালোচনা-পর্যালোচনা থাকে। যেমন এবারে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ঔপনিবেশিক ‘অপরাধের’জন্য ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করার পর ফ্রান্সের পরিবেশমন্ত্রী গত বুধবার বাকুগামী ফ্লাইট বাতিল করেছেন। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলিই তাঁর দলকে আলোচনা রেখে দেশে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। আর প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে আমেরিকার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে উদ্বেগ তো রয়েছেই। বুধবার বারবাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মোটলি বিষয়টি সমাধানের জন্য ট্রাম্পকে মুখোমুখি আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, আমেরিকা চুক্তি থেকে বেরিয়ে গেলে জলবায়ু তহবিলসহ নানান বিষয়ে সঙ্কট তৈরি হতে পারে। পাশাপাশি প্রতি বছর জলবায়ু আন্দোলনকর্মীরা সম্মেলনে বিক্ষোভ দেখান। এবারও বিক্ষোভকারীরা সম্মেলনে রয়েছেন। এবারের মূল দাবি, যে ধনী দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানী পুড়িয়ে এতদিন পৃথিবীকে উত্তপ্ত করেছে, তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কপ-২৯ সম্মেলনের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিশাল ফুটবল স্টেডিয়ামের ছাদে ব্যানার লাগানো হয়েছে। সেখানে লেখা, ‘তহবিল বাড়াও’। ধনী দেশগুলো শিল্পবিপ্লবের সময় থেকে এখন পর্যন্ত এত বেশি কার্বন নিঃসরণ করেছে, যার কারণে জলবায়ু সংকট তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে জলবায়ু অর্থায়নের কোনো সর্বসম্মত সংজ্ঞা নেই। চুক্তি অনুযায়ী এ বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা কিন্তু কিভাবে সেইটাকা দেওয়া হবে তা পরিষ্কার করা নেই চুক্তিতে। দেশগুলো এবারের সম্মেলনে একটি সংজ্ঞায় একমত হতে পারে, আবার নাও পারে। তবে জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকারক কিছু প্রকল্প থেকে সরে আসার সম্ভাবনা আছে। তাছাড়া এবারের আয়োজক দেশ আজারবাইজানের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা নেই বলে অভিযোগ করেছেন থুনবার্গ। কপ-২৯ সম্মেলনগুলো আজারবাইজান এবং আগের দুই আয়োজক সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং মিশরের মতো কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করার অনুমতি দিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। আজারবাইজানকে তিনি একটি দমনমূলক রাষ্ট্র চিহ্নিত করে বলেন, নাগরনো-কারাবাখ ও আর্টসখ অঞ্চলে বসবাসকারী আর্মেনীয় নৃগোষ্ঠীর মানুষের বিরুদ্ধে আজারবাইজানের আলিয়েভ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে।
প্রসঙ্গত, যেসব কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বেড়ে যাচ্ছে তার অন্যতম হলো জীবাশ্ম জ্বালানি। গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বেড়ে বিশ্বের তাপমাত্রা এখন বিপজ্জনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাপমাত্রার একের পর এক বিশ্ব রেকর্ডের মধ্য পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র খরা বা অতিরিক্ত বৃষ্টি, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধসের মতো প্রাণঘাতী ও সম্পদ বিনষ্টকারী প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা যাচ্ছে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশকর্মীরা তাই জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে আন্দোলন করে যাচ্ছেন।