পর্যাপ্ত বৃষ্টির কারণে ২০২৪-২৫ খরিফ মরশুমে প্রায় ১২ কোটি টন চাল উৎপাদন হতে পারে বলে আশা করছে কৃষি মন্ত্রক। তাহলে কী বাজারে চালের সরবরাহ বাড়বে এবং দাম কমবে? গত এক বছরে জে হারে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে তাতে দেশবাসীর দুর্ভোগ চরম সীমায় পৌঁছেছে। প্রতিদিন আলু, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, টম্যাটো, কাঁচা লঙ্কা থেকে শুরু করে প্রতিটি সবজির দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। পাল্লা দিয়ে দাম বাড়ছে ডাল, তেল, নুন, ওষুধ সহ অন্যান্য দ্রব্যের। সাধারণ থেকে শুরু করে দিন আনা দিন খাওয়া মানুষের সংসার চালাতে উদ্বেগ বাড়ছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া হওয়ার জন্য নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কারণ, তারা যতটুকু উপার্জন করছেন তার পুরোটাই জীবনধারণের জন্য খরচ হয়ে যাচ্ছে। টান পড়ছে চিকিৎসা, শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাতে খরচের, এরপর অতিরিক্ত কিছু ক্রয় করার উপায় থাকছে না। দেশের অর্থনীতির জন্য এই পরিস্থিতি মোটেই সুখকর নয়।
জাতীয় পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খুচরো মুদ্রাস্ফীতির হার এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে পৌঁছেছে ৫.৪৯ শতাংশে। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি সেপ্টেম্বরে পৌঁছেছে ৯.২৪ শতাংশে। এই হিসাব গত ন’মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সাধারণ মুদ্রাস্ফীতিতে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির অংশ ৪০ শতাংশের বেশি তাই খাদ্যদ্রব্যের দাম বৃদ্ধির কারণেই মুদ্রাস্ফীতির গতি এত বেশি। উল্লেখ্য, শাক-সবজির দাম বাড়লে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে ঠিকই কিন্তু যারা ফসল ফলায় তাদের আয় বাড়ে না। কারণ, সাধারণ মানুষ যে দামে পণ্য কেনে কৃষক তার অর্ধেক দামও পায় না। আসলে কৃষক থেকে ক্রেতা এর মাঝে রয়েছে অনেকগুলি ধাপ। কৃষকের থেকে পণ্য কেনার পর প্রতি ধাপেই দাম বাড়তে থাকে। ক্রেতা যে দামে বাজার থেকে সবজি কেনে কৃষক তার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ পান। লাভবান হয় ফড়ে আর আড়তদার।
কৃষকদের সঙ্গে ক্রেতাদের সরাসরি যোগাযোগের বেশ কিছু মডেল চালু রয়েছে ঠিকই কিন্তু অধিকাংশের সাফল্য কার্যত অধরাই থেকে গিয়েছে। অন্যদিকে দাম কমানোর ক্ষেত্রে এই মুহুর্তে পেঁয়াজের কথা বলা যায়। এ রাজ্যে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ১৩ লক্ষ মেট্রিক টন। আমাদের রাজ্যে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় না বলাই যায়। কমপক্ষে ৫ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আনাতে হয় মহারাষ্ট্রের নাসিক, কর্নাটক ও অন্ধ্র প্রদেশ থেকে। এ বছর মহারাষ্ট্রে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে মহারাষ্ট্রেই পেঁয়াজের দাম অনেক বেশি, তার উপর বাজারে আসতে দেরি হওয়ায় আমাদের বাজারে দাম ৭০-৮০ টাকা কেজি। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার ভোট ব্যাঙ্ক নিশ্চিত করতে বিনামূল্যে চাল গম বিতরণ করে ঠিকই কিন্তু শুধু ভাত বা রুটিতে কী মানুষের আহার হয় বা ডাল, তেল, আলু, শাক সবজির কী দরকার নেই? সারা দেশের মানুষ যে তিনটি সবজি বেশি খায় সেই ট্যমাটো, পেঁয়াজ ও আলুর দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪২.৪, ৬৬.২ ও ৬৬.৩ শতাংশে। কেবল সবজিতেই নয় ভোগের অন্যান্য বেশ কিছু দ্রব্যেরও অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একটি হল রান্নার তেল, যা গত তিন মাসে ৪৫ শতাংশের বেশি, সাবান এবং প্রসাধনী সামগ্রী এবং ওষুধের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় অর্থ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জেরে মূল্যস্ফীতির সূচক ঊর্ধ্বমুখী। দেশে অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬. ২১ শতাংশ; এর মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০. ৮৭ শতাংশ। হিসাব গত এক বছরে গড় খুচরো মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ; খাদ্যপণ্যের ৮ শতাংশ। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবর মাসে পাইকারি মূল্যস্ফীতি ছিল ২. ৩৬ শতাংশ, যা চার মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এর মূল কারণ হল অত্যাবশ্যকীয় কিছু খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। গত সেপ্টেম্বর মাসে খাদ্যপণ্যের পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি ছিল ১১. ৫৩ শতাংশ। অক্টোবর মাসে তা বেড়ে হয় ১৩. ৫৪ শতাংশ। এর মধ্যে শুধু সবজির পাইকারি মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৬৩.0৪ শতাংশ; তার মধ্যে আলুর দাম ৭৯ শতাংশ, পেঁয়াজের দাম ৩৯. ২৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতে পাইকারি দামের সঙ্গে সাধারণ ক্রেতার সরাসরি সম্পর্ক নেই; কিন্তু খাদ্যপণ্যের পাইকারি দাম যে গতিতে বেড়েছে, তাতে খুচরা বিক্রিতে আজ নয়তো কাল প্রভাব পড়তে বাধ্য। তখন সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। অর্থনীতির সাধারণ তত্ত্ব বলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যদি লাগামছাড়া হয় তাহলে অর্থনীতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। চলতি বছের শেষের পথে, শীতের মরশুমেও কী লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি চলবে বা মধ্যবিত্তকে কি আরও সমস্যায় ফেলবে? উত্তরের অপেক্ষায় সাধারণ মানুষ।