বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বর্ণের এক পার্বনের নাম ছাতা পরব। এই পরব হয় পলাশের দেশ পুরুলিয়ার মাটিতে। পুরুলিয়া শহর থেকে ১১ কিমি দূরে চাকলাতোরের মাঠে। আসানসোল টাটানগর লাইনে পুরুলিয়ার পরের স্টেশনই হল টামনা। সেখান থেকে গাড়িতে পৌঁছানো যায় ছাতার মাঠে। ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মা পুজো, রান্না পুজো ও ভাদু পুজোর সঙ্গে ছাতা পরবে ভীড় করেন মানভুম ও মল্লভূমের বিরাট সংখ্যক সাধারণ মানুষ। ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান এমনকি ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা থেকে আসা মানুষ, ধামসা মাদলের বোলে সম্মিলিতভাবে গেয়ে ওঠে–‘মিৎপন বার গণ্ডা পুয়সা মাইরী এমাঃ মে/তুকুর মাইরী চিনি লাডু দ/ চাকুলতাড়ি ছাতা মাইরী…’
চাকলতোড়ের ছাতা পরবকে নিয়ে নানান কাহিনী ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে । স্বাধীনতা আন্দোলনে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জেলার মধ্যে পুরুলিয়া জেলারও একটি বিশেষ ভূমিকা ছিল। পঞ্চকোটরাজ নীলমণি সিংদেও স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে সকলে সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ বিরোধীতায় নামে। প্রচলিত কথায় শোনা যায়, ভাদ্র মাসের এই সংক্রান্তির দিনটিতে পঞ্চকোটরাজার নির্দেশে হাজার হাজার সাঁওতাল-আবালবৃদ্ধবনিতা এই চাকলতোড়ের বিস্তীর্ণ মাঠে সমবেত হন এবং তাঁরা সকলেই শপথ নেন সমবেত আন্দোলনে নামার। এই দিনটিতে সমস্ত আদিবাসী প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে তাঁরা প্রতি বছর এই দিনটিতে অন্তত একদিনের জন্য হলেও মিলিত হবেন। এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৮৫৭ সাল থেকে এই পরব ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
কেউ বলেন, প্রাচীন পঞ্চকোট রাজারা পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে শান্তির বার্তা স্বরূপ সাদা ছাতা উত্তোলন করে শত্রু রাজ্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেছিলেন। তারপর থেকে এই ছাতা উৎসব সেই শান্তি ও বন্ধুত্বেরই স্মরণে এখনও প্রচলিত। অনেকে আবার বলেন, ইংরেজ সাহেবদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে চুয়াড় বিদ্রোহে সাময়িক জয়লাভ করে জঙ্গলমহলের পুরুলিয়া প্রদেশের পঞ্চকোট ও কাশীপুরে রাজারা এই ছাতা মেলার প্রচলন করেছিলেন। সেই প্রাচীন কাল থেকেই ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বয়ে নিয়ে আসছে এই বিরলতম উৎসব।
চাকলতোড়ের ছাতা মেলার প্রাক্তন সম্পাদক কালীপদ কিস্কুর থেকে শোনা যায় আর এক গল্প। তাঁর কথা অনুযায়ী আনুমানিক ১৮৫৫ সালে, ভারতবর্ষ তখন ইংরেজ অধ্যুষিত একজন সাঁওতাল রমনীকে ইংরেজ সেনারা আক্রমণ করে। সেই মেয়েটি নিজের সম্মান বাঁচাতে গ্রামে এসে উপস্থিত হয়। তখন সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। যুদ্ধ বাঁধে ইংরেজদের সঙ্গে।এই যুদ্ধে পঞ্চকোট রাজা সাহায্য করেছিলেন। কালীপদ বাবুর কথা অনুযায়ী, সেটা রাজা গন্ধর্ব সেনের রাজত্বকাল। যুদ্ধে অস্ত্রের যোগান দিয়ে সাহায্য করেছিলেন পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজা। যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যদের হারিয়ে আদিবাসী আর দেশীয় রাজারই জয় হয়।
ছাতার মাঠের পাশেই আছে ছাতা পুকুর। সেটা নিয়েও আদিবাসী সমাজে নানা গল্প প্রচলিত আছে। রাজা লালদেও সিং-এর পূর্বপুরুষরা যখন এই পুকুর খনন করছিলেন, সেই সময় সেই পুকুরের মাঝখান থেকে একটি সোনার ছাতা ভেসে ওঠে, ছাতা পরব সেই থেকে প্রতি বছর ভাদ্র সংক্রান্তিতে পালিত হয়। গল্প বা ইতিহাস যাই বলুক না কেন, এই পরব ও মেলা সাঁওতালদের। মেলায় হাজার হাজার মেয়ে,পুরুষ,বাচ্চা,বুড়ো সাঁওতাল দলে দলে হেঁটে, সাইকেল, ট্রেকার চেপে ছাতা পরবে আসে। বিশাল মাঠ জুড়ে মেলা বসে। আর তার পাশেই আরেকটা মাঠ, যেটাকে সবাই ছাতার মাঠে দূর থেকে দেখা যায় বিশাল উঁচুতে একটা সাদা ছাতা। লোক মুখে শোনা আসল ছাতাটি সোনার। সেটি মখমলের সাদা কাপড়ে সারা বছর রাজবাড়ির মন্দিরে মোড়া থাকে। ইন্দ্রদেবের পুজো ও রুমাল ওড়ানোর পর গগনচুম্বী সাদা ছাতা উত্তোলন করে এই মেলার উদ্বোধন করেন পুরুলিয়ার পঞ্চকোট রাজপরিবারের বংশধর। পঞ্চকোট রাজা নিজে সাঁওতাল না হলেও সাঁওতাল পরবকে মর্যাদা দেন। পুরোহিত মশাই ওই শালের গুড়ির নীচে বসে কুলদেবতার পূজা করেন। রাজা আসেন কাসর,ঘন্টা,শঙ্খ, শিঙা ধামসা,মাদল বাজিয়ে। পরনে রাজবেশ, মাথায় পাগরি,পায়ে নাগরাই,কোমরে তলোয়ার গোঁজা। রাজা ছাতার চার পাশ তিন পাক ঘুরে সষ্টাঙ্গে কূলদেবতাকে প্রণাম করে সরাসরি হেঁটে চলে যান উঁচু একটা বেদির উপর। রাজা সেখান থেকে একটা সাদা রং এর রুমাল উড়িয়ে কপিকলের সাহায্যে ছাতা উত্তোলন করেন। হাত তালি দিয়ে জনগন অভিবাদন জানায়।
রাজ্যের প্রাচীনতম ছাতা মেলায় আদিবাসীদের ধামসা ও মাদলের তালে নৃত্য, বাউল গান, ঝুমুর গান, ছৌ নাচ , মুরগি লড়াই, এর সঙ্গে রকমারি জিনিসের দোকান, হস্তশিল্পের জিনিস ও কৃষিজ পণ্যের পসরা সাজানো থাকে। প্রাচীন এই মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত কিছু রীতি। এই মেলায় ঘুরতে ঘুরতেই আদিবাসী তরুণ- তরুণীরা নিজেদের জীবনসঙ্গী পছন্দ করেন। আর একবার মনের মতো জীবন সঙ্গী পছন্দ হয়ে গেলেই এক রাত্রেই সোজা বিয়ে। সাঁওতাল সমাজে আজও একটা সংস্কার আছে তাঁদের মেয়েদের জীবনে, অন্তত একবার এই মেলায় যেতে হবে। এর পেছনে কী কারণ আছে জানা নেই, তবে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে এই মেলায় মেয়েরা যখন এসে নাচে গানে অংশ নেয়। তখন তার মনের উদারতা বাড়ে। আদিবাসী সংস্কৃতি সম্পর্কে সে হয়ে ওঠে সচেতন।
আদিবাসীদের প্রচলিত লোকগানেও এই মেলায় মেয়েদের যাওয়ার তাৎপর্য তুলে ধরা হয়েছে। ‘…চাকুত-তাড়ি ছাতা মাইনা/ কোসজুড়ি পাতা/দে সাইনা জেলার চালা: থান।/ দিন বাংলা: বছর রুওয়াত/ ঘুরে ফিরে রুওয়াড়/ নওয়া হড়ম না ওয়া জিউরী য়াং রুওয়াড়া…’ অর্থাৎ, চল বোন চাটলতোড়ের ছাতা আর কোস জুড়ির পাতা নাচ দেখতে যাব। দিন চলে যায় বছর আসে কিন্তু এই দেহ এই জীবন আর ফিরে আসবে না। প্রথমদিকে যদিও মেলা এত সংগঠিতভাবে হত না।দেশজ রাজার সাথে আদিবাসী জন গোষ্ঠীর মতভেদও হয়েছে নানা বিষয়ে।পরবর্তি সময়ে মানে ১৯৮২ সাল থেকে কমিটি গঠনের মাধ্যমে মেলা পরিচালনা করা হচ্ছে।ধিরে ধিরে বিষয়টা অনেক সংগঠিত হচ্ছে। মেলার ব্যাপ্তি হয়েছে।