একই মন্দিরে রক্ষাকালী ও দক্ষিণকালী পাশাপাশি। কেবল তাই নয়, তাঁদের দু’জনেরই অধিষ্ঠান আবার শিবের ওপর। সেই কারণেই এখানকার কালী প্রতিমা অন্য যে কোনো জায়গার প্রতিমার থেকে আলাদা।এক অলৌকিক ইতিহাস রয়েছে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা নিয়েও। কথিত আছে লক্ষ্মী দাস নামে এই ময়দানপুরের এক মহিলা দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাঁর বাড়ির কাছেই মনসা গাছ রয়েছে। সেই গাছের মাটির তলায় তাঁরা আছেন। তাঁদের মাটি থেকে তুলে পুজো করতে হবে। দেবী তাঁকে নাকি স্বপ্নে এমনটাই জানিয়েছিলেন। এ কথাও জানিয়েছিলেন,পরদিন থেকেই করতে হবে পুজো। দেবীর সেই স্বপ্নাদেশের পরদিন ছিল শ্যামাপুজো।

লক্ষ্মী দাস সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাড়ির আগের রাতের স্বপ্নের কথা সবাইকে জানালেন। কিন্তু, কেউ তাঁর কথা বিশ্বাস করলেন না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লক্ষ্মী দাসঅনেক জোরাজুরি করায় শুরু হয় মাটি খোঁড়ার কাজ। বেশ কিছুটা মাটি খোঁড়ার পর উদ্ধার হয় জোড়া কালীমূর্তি। এরপর যেখান থেকে কালীমূর্তি দুটি উদ্ধার হয়, সেই মনসা গাছের পাশেই তৈরি করা হয় দেবীর বেদী। মাটির নীচ থেকে দুটি কালীমূর্তি উদ্ধারের খবর ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। এবার পুজোর পর্ব। সেখানেও চমক জাগান লক্ষ্মী দাস। কথিত আছে, অন্য কোনও ব্রাহ্মণ-পুরোহিত নয়,লক্ষ্মী দাস নিজেই এই পুজো শুরু করেন। প্রথম অবস্থায় গ্রামের অনেকেই তা মেনে নিতে পারেন নি তবে পরবর্তীকালে তাঁরা এটা মেনে নেন।
এরপর দেবীর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী ওই বেদীর স্থানে মন্দির নির্মাণ করা হয়। পঞ্চম দোলে স্থায়ীভাবে দেবীর বিগ্রহ তৈরি করে প্রতিষ্ঠার পর পুজো শুরু হয়। সেসব আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগের ঘটনা। বর্তমানে লক্ষ্মী দাসের পরিবারের লোকজন বংশপরম্পরায় এই পুজো করে চলেছেন। দেবীকে এখানে নিত্য পুজো করা হয়। এই মন্দিরে দুই কালী প্রতিমার পাশে দেবী লক্ষ্মীর মূর্তিও রয়েছে। দেবী লক্ষ্মীকেও এখানে নিত্য পুজো করা হয়।

নদিয়া জেলার ভীমপুরের ময়দানপুরের কালির খুব নামডাক। নিম্ন বর্গীয় মানুষের বাস এখানে। তবে যে কোনও বর্গের মানুষ বিশেষ করে তপশিলী জাতি / উপজাতি মানুষের আরাধ্য দেবী মা হিসাবে ময়দানপুরের কালি পূজিত হয়ে আসছেন। সাত-পুরুষ ধরে প্রতি মঙ্গলবার পুজো হয়ে আসছে। দাস বংশের কূলবধূ মাননীয়া লক্ষ্মীদেবী স্বপ্নে আদেশ পেয়ে যে কালি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন সেই মন্দিরের বেদীতে পাশাপাশি দুটি কালি প্রতিমারপাশে রয়েছে একটা লক্ষী মূর্ত্তি। মোট তিনটি। দুটি কালি মূর্তি অর্থাৎ রক্ষাকালী ও দক্ষিণকালীর পরনে লালরঙের শাড়ী আর লক্ষীর পরণে গাঢ় গোলাপি রঙের শাড়ি। তিন জনের মাথায় বেশ বড় মাপের মুকুট। দুই কালির চার হাতে অস্ত্র। অতীতে মহিষ বলি হত এখন শুধু পাঠা বলি হয়। যাদের মানত পূর্ণ হয় তারা বলি দেয়।

বছরে পঞ্চম দোলে বাৎসরিক পুজো হয়, রঙ দোলের পরে পঞ্চম দিন। সকাল থেকে সারাদিন ধরে পুজো চলে। চব্বিশ প্রহর ধরে কীর্তন হয়। মানত পূর্ণ হওয়ার ফলে অনেকে পুজো দেয়। গ্রামের মানুষ নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী মাথায় করে বস্তায় ভরে পুজোর সামগ্রী নিয়ে আসে। সঙ্গেঢাকিরা ঢাক বাজাতে বাজাতে আর পরিবারের লোকজন শঙ্খ আর উলুধ্বনি দিতে দিতে মন্দিরে আসে। ভোগ বিতরণ হয়। ছোটো মেলা বসে। দূর-দূরান্ত থেকে ভক্তদের ঢল নামে। স্থানীয় গ্রামের মানুষ আবেগে গর্ববোধে উত্তাল হয়ে পড়ে। বহু বছর ধরে এই উৎসব ও উন্মাদনা।
যেভাবে যেতে পারেনঃ শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর স্টেশন থেকে টোটোয় ময়দানপুর ২৬ কি মি মাত্র। অথবা গেদে লোকালে মাজদিয়া স্টেশনে নেমে অটো, বা টোটোয় ময়দানপুর ২৫ কিমি। বাসে সাকদহ মোড়ে নেমে টোটোয় ১৩ কিমি ময়দানপুর।