প্রায় ছ’বছর পর গত ৪ নভেম্বর জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভার অধিবেশন বসেছিল। অধিবেশনের প্রথম দিনই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। গত সোমবার জম্মু ও কাশ্মীর বিধানসভায় মেহবুবা মুফতির দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি)-র বিধায়ক ওয়াহিদ পাররা ৩৭০ বাতিলের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পেশ করেন। তার পরেই বিজেপি বিধায়কেরা বিধানসভায় হইচই শুরু করে দেন। বিধানসভার সদ্য মনোনীত স্পিকার, ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) বিধায়ক রহিম রাঠেদারও জানান, এই ধরনের প্রস্তাবকে তিনি অনুমোদন করছেন না। তার আগে জম্মু ও কাশ্মীরের উপরাজ্যপাল মনোজ সিনহাও তাঁর বক্তব্যে অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, সরকার রাজ্যের তকমা ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা করবে। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগেই কাশ্মীরের নবনিযুক্ত মন্ত্রিসভা অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে ফের রাজ্যের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের সপক্ষে প্রস্তাব পাশ করে। সেই প্রসঙ্গও উঠে আসে রাজ্যপালের ভাষণে। বিধানসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার পর বিধায়কেরা কাশ্মীরের চারার-ই-শরিফ বিধানসভা কেন্দ্রের সাত বারের বিধায়ক রাঠেদারকে ধ্বনিভোটে স্পিকার হিসাবে নির্বাচিত করেন। অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের প্রসঙ্গে বলতে উঠে মুখ্যমন্ত্রী ওমর বলেন, ২০১৯ সালে ৫ অগস্ট নেওয়া সিদ্ধান্ত জম্মু ও কাশ্মীরের মানুষ সমর্থন করেনি। যদি তাঁরা সেটা করতেন, তবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল অন্য রকম হত।
কার্যত, বুধ, বৃহস্পতি এবং শুক্রবার ৩৭০ ধারা নিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠল জম্মু–কাশ্মীর বিধানসভা। তিনদিনই তুলকালাম পরিস্থিতি হয় বিধানসভায়। বুধবার ন্যাশনাল কনফারেন্স সরকারের তরফে ৩৭০ ধারা ফেরানোর দাবিতে বিধানসভায় একটি প্রস্তাব পাশ করানো হয়। উপত্যকায় বিশেষ মর্যাদা ফেরানো নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু হোক- এই মর্মে প্রস্তাব পাশ করায় ওমর আবদুল্লার সরকার। বিজেপি প্রতিবাদ করলেও প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। এরপর বৃহস্পতিবার কাশ্মীর বিধানসভায় ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির প্রতিবাদে একটি ব্যানার নিয়ে হাজির হন বারামুলার সাংসদ তথা আওয়ামি ইত্তিহাদ পার্টির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার রশিদের ভাই খুরশিদ আহমেদ শেখ। ওই ব্যানারে দুটি দাবি লেখা ছিল। ৩৭০ ধারা পুনর্বহাল করতে হবে এবং রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে খুরশিদ আহমেদ শেখের ওই ব্যানার প্রদর্শনে আপত্তি জানায় বিজেপি। বৃহস্পতিবারও একই বিষয় নিয়ে কাশ্মীর বিধানসভায় রীতিমতো হাতাহাতি হয় যার ফলে শেষ পর্যন্ত স্পিকার আব্দুল রহিম অধিবেশন মূলতুবি করে দেন। শুক্রবারও হাতাহাতিতে জড়ান শাসক ও বিরোধী দলের বিধায়করা। শেষমেশ মার্শাল ডেকে কয়েকজন বিজেপি বিধায়ককে বিধানসভা কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রতিবাদে বিজেপি ওয়াকআউট করে।
প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট নরেন্দ্র মোদী সরকার ৩৭০ নম্বর ধারা বাতিল করে। তার আগে অনুচ্ছেদ ৩৭০ জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দিত। এছাড়া পররাষ্ট্র সম্পর্কিত বিষয়, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বাদে অন্যান্য সব ক্ষেত্রে স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও দিত। অর্থাৎ ৩৭০ অনুচ্ছেদ জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশেষ ধরনের স্বায়ত্বশাসন ভোগ করার অধিকার দিয়েছিল, যা রাজ্যটিকে নিজস্ব সংবিধান, আলাদা পতাকা এবং আইন তৈরি করার অনুমোদন দেয়। পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং যোগাযোগ বিষয়ক ব্যাপারের নিয়ন্ত্রণ থাকতো কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। ফলস্বরুপ জম্মু ও কাশ্মীর নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত আইন নিজেরা তৈরি করার ক্ষমতা রাখতো। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের মানুষকে জম্মু ও কাশ্মীরে জমি কেনা এবং সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করা থেকেও বিরত রাখতে পারতো ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি দীর্ঘসময় ধরে অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর বিরোধিতা করে আসছে। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায আসার পর ২০১৯ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতের সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয় ভারতের সরকার। ঐ অনুচ্ছেদের বদৌলতে।ফলে বিশেষ মর্যাদা হারায় জম্মু ও কাশ্মীর। এমনকি, কেড়ে নেওয়া হয় রাজ্যের তকমাও। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যকে ভেঙে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ— দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলা হয়েছিল। কিন্তু ২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বরের রায়ে প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের বেঞ্চ জানিয়ে দেয়, ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপের সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক নয়।