৯ অগাস্ট থেকে ৯ নভেম্বর, আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ঘটে যাওয়া সেই ভয়াবহ ঘটনার তিন মাস পেরলো। যে বীভৎস ও পৈশাচিক ঘটনার প্রতিবাদের কেবল গোটা বাংলা নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে ঝড় উঠেছিল গোটা বিশ্বজুড়ে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার তিন মাসের মাথায় শনিবার ফের রাস্তায় নামলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। কেবল তাঁরাই নন, প্রচুর সাধারণ মানুষও জড়়ো হয়েছিলেন এদিন। একাধিক কর্মসূচি ছিল কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে। কিন্তু এটা ঘটনা দীর্ঘ আন্দোলন, টানা ১৭ দিন আমরণ অনশনের পর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মৌখিক প্রতিশ্রুতির পরও ন্যায় বিচার কিন্তু অধরাই থেকে গিয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জে মামলার শুনানি করেছেন, সিবিআই তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আশা আলো কেউই দেখাতে পারেনি বরং জুনিয়ার ডাক্তাররা শুনানি এবং তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে হতাশ হয়েছেন। তাই সেই ঘটনার ৩ মাস পার হতেই বিচারের দাবিতে ফের পথে নামতে বাধ্য হলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। তাদের ডাকে ফের রাজপথে নাগরিক মিছিল। বিচারের দাবিতে একহাতে সংবিধান, একহাতে ন্যায়ের প্রতীক নিয়ে মিছিল পরিক্রমা করলো কলেজ স্ট্রিট থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। ধর্মতলায় অভয়া মঞ্চের ডাকে ‘জনতার চার্জশিট পেশ হল’। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ‘দ্রোহের গ্যালারি’।
জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের তরফে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে দ্রোহের গ্যালারি তৈরির ডাক দেওয়া হয়েছিল। এসএসকেএম চত্বরে রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করে দ্রোহের গ্যালারি। মেডিক্যাল কলেজ এবং আর জি কর চত্বরেও তৈরি হয় অভয়া গ্যালারি। আর জি কর চত্বরেও হয়েছে প্রদর্শনীর আয়োজন। গত তিনমাস আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি সংক্রান্ত ছবি, পোস্টার দিয়ে সাজানো হয় এই প্রদর্শনী। জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের দাবি আন্দোলন থেকে তাঁরা যে সরে আসেননি সেকথা বোঝাতেই এই দ্রোহের গ্যালারি। আর কতদিন বিচারহীন? এই প্রশ্নকে সামনে রেখেই, জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্টের ডাকে আর জি কর কাণ্ডের তিন মাস পূর্তি উপলক্ষে ফের কলকাতার রাস্তায় নামলেন জুনিয়র ডাক্তার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। এর আগে দেখা গিয়েছিল প্রতীকী শিরদাঁড়া, মস্তিষ্কের মডেল শনিবার বিচারের দাবিতে, হাতে লেডি জাস্টিসের মূর্তি নিয়ে পথে নামলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। চিকিৎসককে খুন-ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় অনেক আগেই দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও আছড়ে পড়েছিল। সরব হয়েছিলেন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় চিকিৎসক ও ডাক্তারি পড়ুয়ারা। তাঁদের মতোই এই একজন চিকিৎসক। আজকের নাগরিক মিছিলে সামিল হবেন বলে, চলে এসেছেন সুদূর কানাডা থেকে। প্রসঙ্গত, এদিন কলকাতার পাশাপাশি অনেক জেলাতেও আর জি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে আন্দোলন হয়, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে মিছিল মহিলাদের মিছিলে আওয়াজ ওঠে- WE Want Justice।
গত ৮ অগস্ট গভীর রাতে আরজি করের চারতলার সেমিনার হল থেকে ডাক্তারি ছাত্রীর রক্তমাখা দেহ উদ্ধার হয়েছিল। কর্মস্থলে এভাবে ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ-খুনের প্রতিবাদে সেদিন থেকেই গর্জে উঠেছিল সমাজ। ঘটনার ৪দিন পর তদন্তভার গ্রহণ করে সিবিআই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়। খুন ধর্ষণ কাণ্ডে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। পরে তথ্য প্রমাণ লোপাটের অভিযোগে আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ, টালা থানার আইসি অভিজিৎ মণ্ডলকে গ্রেফতার করে সিবিআই। তবে ধর্ষণ-খুন কাণ্ডে সঞ্জয় ছাড়া দ্বিতীয় কোনও গ্রেফতার হয়নি। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার ভূমিকা নিয়ে একাধিক প্রশ্ন রয়েছে আন্দোলনকারী ডাক্তারি পড়ুয়া থেকে নির্যাতিতার পরিবারের। যদিও সিবিআই-এর তরফে ইতিমধ্যে শিয়ালদহ আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে চার্জশিট। আগামী ১১ নভেম্বর থেকে নিম্ন আদালতে শুরু হবে শুনানি পর্বও। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, তদন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে।
তবু বিচারের দাবিতে শনিবার ফের বৃহত্তর আন্দোলনে নামলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। ইতিমধ্যে গত ৬ নভেম্বর এ ব্যাপারে মুখ্যসচিবকে চিঠি দিয়ে হাসপাতালের নিরাপত্তা, পরিকাঠামোগত উন্নতি-সহ একাধিক দাবি দাওয়া নিয়ে ফের আলোচনা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট। প্রসঙ্গত, বিচারের দাবিতে ধর্না অবস্থানের পর ১০ দফা দাবিতে ধর্মতলায় টানা আমরণ অনশনে বসেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। গত ২১ অক্টোবর নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন জুনিয়র চিকিৎসকরা। ওই বৈঠকে প্রশাসনিক আশ্বাসের পর অনশন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। মুখ্যসচিবকে পাঠানো চিঠিতে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জুনিয়র চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলি এখনও পূরণ হয়নি। রাস্তায় এদিন ফের নানা ধরনের স্লোগান লেখা হয়। ন্যায় বিচারের দাবিতে বার বার ওঠে স্লোগান। দূরের জেলা থেকেও বহু মানুষ এসেছিলেন এদিনের মিছিলে। ব্যানারে লেখা ছিল নাগরিকদের মিছিল। WBJDF-এর ডাকে নাগরিকদের মিছিল। গোটা বিষয়টি যে কেবল জুনিয়র ডাক্তার বা সিনিয়র ডাক্তারদের নয় সেটাই বার বার বোঝাতে চেয়েছেন চিকিৎসকরা।