ইতিহাসে যে শাসকের শাসন আমল ছিল কেবলই ধ্বংস, অপহরণ ও হত্যাযজ্ঞ, সেই শাসকই ঘোড়ায় চড়ে জয় করেছিলেন প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ বর্গমাইলের বিশাল এক অঞ্চল। দুর্ধর্ষ মোঙ্গল সেনাপতি চেঙ্গিস খান ধ্বংস ও রক্ত পাতের এক ভয়াল প্রতিশব্দ। ক্ষমতালিপ্সু এই শাসকের শাসনের ৮শ বছর পরও জানা যায়নি তার সমাধিটি কোথায়? তার মৃত্যু ঘিরেও রয়েছে নানা কিংবদন্তি। বলা হয়ে থাকে, সম্ভবত ঘোড়ার থেকে পড়ে নয়তো যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার কারণে তার মৃত্যু হয়েছিল। তার সমাধি ঘিরেও রয়েছে রহস্য, তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রচলিত আছে, তার শেষকৃত্য খুবই গোপনে করার জন্য তিনি খুবই সূক্ষ্মভাবে পরিকল্পনা করেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী, তার মরদেহকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি সেনাবাহিনীরও ব্যবস্থা করেছিলেন। সে সময় শোকগ্রস্ত সেনাবাহিনী তার মরদেহ জন্মভূমি মঙ্গোলিয়ায় নিয়ে ফিরছিল। তার মরদেহ বা সমাধির পথ যাতে কেউ খুঁজে না পায়, সেজন্য তারা পথে যাকেই পাচ্ছিল তাকেই হত্যা করছিল। তাকে সমাহিত করা শেষ হলে শেষ্যকৃত্যে যোগ দেওয়া সেনা সদস্যদের প্রত্যেকই আত্মাহুতি দিয়েছিলেন।
উত্তর চীনে খেন্তি পর্বতমালার বুরখান খালদুন চূড়ায় তাকে সমাহিত করা হয়েছিল বলেও প্রচলিত আছে।কিন্তু আজও পর্যন্ত কেউ তার সমাধিসৌধকে আবিষ্কার করতে পারেনি। এমনকি তার সমাধির এলাকাও প্রাচীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্য হয়েই থেকে গেছে। ঐতিহাসিক বর্ণনা ও সাম্প্রতিক আরও নতুন গবেষণায় চেঙ্গিস খানের সমাধিস্থল হিসেবে সম্ভাব্য অন্য আরও জায়গা নির্ধারণ করে। যেমন ইউয়ান রাজবংশের মতে ১২৭১ থেকে ১৩৬৮ সন পর্যন্ত চীন শাসন করা সব মঙ্গোল সম্রাটদেরই কিনিয়ান উপত্যকায় সমাধিস্থ করা হয়েছিল। তবে এই উপত্যকা কোথায় তার কোনো রেকর্ড নেই।আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব অনুসারে, চেঙ্গিস খানের সমাধি ২০০৪ সালে আবিষ্কৃত হওয়া তার প্রাসাদের কাছেই রয়েছে।ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে বহুজাতিক প্রকল্প ও টেলিভিশনের অনুসন্ধান চালানোর মাধ্যমে অনেকেই চেঙ্গিস খানের হারিয়ে যাওয়া সমাধি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। এত সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রহস্য হয়েই রয়ে গেছে। চেঙ্গিস খানের সমাধি খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে দেশ হিসেবে মঙ্গোলিয়া নিজেই একটি বাধা। ৬ লাখ ৩৯ হাজার ৯ বর্গমাইলের বিশাল আয়তনের মঙ্গোলিয়া বিশ্বের ১৮তম বৃহত্তম দেশ। বিরাট ও বিশাল মঙ্গোলিয়ায় তার সমাধিস্থানকে খুঁজে বের করা যেন বিশাল খড়ের গাদার মধ্যে একটি সূচ অনুসন্ধান করা। তার সমাধি অনুসন্ধানে বিদেশি অভিযানগুলো ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুসারে পরিচালিত হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকস ‘ভ্যালি অব দ্য খানস’প্রকল্পের গবেষকরা তার সমাধি খুঁজে পেতে জমি ও আকাশজুড়ে বিস্তৃত অভিযান চালিয়েছে। তার মৃত্যুর পর তিনি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন যে, বর্তমান মঙ্গোলীয় মুদ্রা এমনকি পানীয় ভদকার বোতলেও তিনি ছবি হয়ে আছেন। তাই তার সমাধিকে খুঁজে বের করা কেন ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে, তা যে কোনো বিদেশির পক্ষে বোঝা মুশকিল।
চেঙ্গিস খানের সমাধিকে ঘিরে যত কিংবদন্তি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে নাটকীয় হলো, যদি কখনো এই সমাধি খুঁজে পাওয়া যায় তাহলে তখনই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। তৈমুর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা তৈমুর লংয়ের সমাধি সম্পর্কেও একই ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে। চেঙ্গিস খানের সমাধির ভেতরে কী রয়েছে তা ঘিরেই অন্য কিংবদন্তিগুলো রয়েছে। জানা যায়, মঙ্গোল সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রচুর ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল। আরও প্রচলিত আছে, চেঙ্গিস খান তার ছোট ছেলে তোলুই, তোলুইয়ের স্ত্রী ও তাদের ছেলেদের সঙ্গে তার সমাধি ভাগ করে নিয়েছিলেন। তারা হলেন তলুইয়ের ছেলে মংকে খান, আরিগ বোকে ও চীনের ইউয়ান রাজবংশের শাসক কুবলাই খান। প্রচলিত আছে, দারখাদ নামের উরিয়ানখাই গোত্র চেঙ্গিস খানের সমাধি রক্ষা করে আসছে। সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চেঙ্গিস খানের সমাধি নামে একটি স্থান রয়েছে। তবে মঙ্গোলিয়ার ভেতরে অবস্থিত ওই স্থানটি চেঙ্গিস খানের আনুষ্ঠানিক কোনো সমাধিক্ষেত্র নয়। বরং ওই সমাধিটি তাকে উৎসর্গ করা একটি মন্দির।
উল্লেখ্য, চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার আগ্রহে বিদেশিরাই বারবার যুক্ত হয়েছেন। মঙ্গোলিয়ানদের মধ্যে চেঙ্গিস খানের সমাধি খোঁজার আগ্রহ দেখা যায়নি। বেশ কয়েকজন গবেষক জানান, চেঙ্গিস খান নিজেই চেয়েছিলেন তার সমাধি যেন লুকানোই থাকে। আর তা-ই ঘটেছে। জানা যায়, পৃথিবীর অর্ধেক ধনসম্পদই নাকি গচ্ছিত আছে চেঙ্গিসের সমাধিতে। চেঙ্গিস খানের সব ধনদৌলত এমনকি ৭৮ রাজার মুকুটও সেখানেই নাকি রাখা আছে। সর্বশেষ ১৯৯০ সালে মঙ্গোলীয়ার উলানবাটার স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. দিমাজাব আরডেনেবাটারি একটি উদ্যোগ নেন। জাপানের সঙ্গে যৌথ এ উদ্যোগের নাম ছিল ‘তিন নদী প্রকল্প’। সেটিও ব্যর্থ হয়। আজও চেঙ্গিস খানের সমাধির রহস্যের সমাধান মেলেনি।