আজকের কল্পবিজ্ঞানই আগামী দিনের বাস্তবতা। আজ প্রযুক্তির যে সুফল মানুষ ঘরে তুলছে, তার অনেকটাই উঠে এসেছে কল্পবিজ্ঞানের পাতা থেকে। সায়েন্স ফিকশনের সবচেয়ে চমকপ্রদ দিক হলো, এর মাধ্যমে আমরা সেই সব ঘটনা জানতে পারি, যেগুলো ভবিষ্যতে ঘটা সম্ভব। একটু পেছনে তাকালেই বোঝা যায়। বর্তমানের ক্রেডিট কার্ড, ট্যাব, সাবমেরিন, চালকবিহীন গাড়ি, মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বা বাড়িঘর নির্মাণে থ্রি-ডি প্রিন্টারের ব্যবহার, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইটের ব্যবহার ইত্যাদির ধারনা অনেক আগেই এসেছিল সায়েন্স ফিকশন থেকে।
মহাবিশ্বের যে কোনো বস্তুকে ভাঙলে শেষমেশ একই প্রজাতির মৌলিক কণা অর্থাৎ ইলেকট্রন, কোয়ার্ক ইত্যাদি পাওয়া যায়। এই সব মৌলিক কণার বিভিন্ন বিন্যাসের মাধ্যমে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন বস্তু। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে পোশাক-আশাক, ঘরবাড়ির ইট-বালি-সিমেন্ট, চেয়ার-টেবিল সবকিছুই একই মৌলিক কণার সম্মিলনে তৈরি! এই ধারণাকে প্রথম টেলিভিশন পর্দায় তুলে আনে বিখ্যাত চলচ্চিত্র স্টার ট্রেক। সিনেমাটিতে দেখানো হয় রেপ্লিকেটর নামের একটি যন্ত্র কমান্ড শুনে তৈরি করে দিতে পারে যেকোনো খাদ্যবস্তু। শুধু খাদ্যবস্তু কেন, যে কোনো বস্তুই তৈরি সম্ভব এই উপায়ে। সিনেমাটি মুক্তির পর মৌলিক কণা দিয়ে বস্তু তৈরি বাস্তবজগতে সম্ভব না হলেও ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট উপকরণ দিয়ে বিভিন্ন বস্তু তৈরি করা গিয়েছে। আর যে যন্ত্র এই কাজ করছে, তার নাম থ্রি-ডি প্রিন্টার। থ্রি-ডি প্রিন্টার দিয়ে শুধু খাদ্যদ্রব্য বা নানা কলকব্জা তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে, প্রিন্ট করে তৈরি করা হচ্ছে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। সেগুলো মানুষের দেহে প্রতিস্থাপনও করা হচ্ছে। থ্রি-ডি প্রিন্টারের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রিন্ট করে নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি।
এডওয়ার্ড বেলামির ‘লুকিং ব্যাকওয়ার্ড’ প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে হইচই ফেলেছিল। সেই কাহিনিতে কল্পলোকের নাগরিকরা ইউনিভার্সাল ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। তারা কাগুজে নোটের বদলে ক্রেডিট কার্ডের কেনাবেচা করেন। ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট খরচের মাধ্যমে কেনাকাটা সম্ভব হয়। একালের ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, এটিএম কার্ড—সবই সেই কল্পনার ফসল। জুল ভার্ন –এর অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাসগুলো শুধু কল্পগল্প নয়, তথ্য ও প্রযুক্তির উৎস। জুল ভার্ন তাঁর ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’তে বিদ্যুচ্চালিত সাবমেরিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন। সেখানে দেখা যায়, রহস্যময় চরিত্র ক্যাপ্টেন নিমো তার অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় তৈরি করেন নটিলাস নামের সাবমেরিন। সেই সময় অনেক বিজ্ঞানীই সাবমেরিন তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, কিন্তু জুল ভার্ন সেটির কারিগরি ও কাঠামোগত যে বর্ণনা দেন, তা সবার কল্পনাকে ছাড়িয়ে যায়। বইটি সাবমেরিন তৈরির গবেষণায় ব্যস্ত বিজ্ঞানীদের চিন্তায় স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়। বইয়ের সেই সাবমেরিন অনুপ্ররণা জোগায় আমেরিকান যন্ত্রপ্রকৌশলী ও নৌবাহিনীর স্থপতি সাইমন লেককে। পরবর্তীকালে নিরলস গবেষণার ফলে ১৮৯৮ সালে প্রথম তাঁর গবেষণালব্ধ সাবমেরিন, যার নাম আর্গোনট সমুদ্রে চলাচল শুরু করে।
কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের রয়েল এয়ার ফোর্সে রাডার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ শুরু করেন। সে সময়ই তার মাথায় অবিস্মরণীয় একটি আইডিয়া খেলে যায়। তিনি কল্পনা করেন, চাঁদের মতো কোনো উপগ্রহ যদি প্রতিফলক হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে সহজেই পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। চাঁদ পৃথিবী থেকে বেশি দূরে বলে তিনি কৃত্রিম যোগাযোগ উপগ্রহ বা আর্টিফিশিয়াল কমিউনিকেশন স্যাটেলাইটের কথা চিন্তা করেন। সেই সঙ্গে স্যাটেলাইট বসানোর জন্য ভূ-ত্বক থেকে প্রায় ২২ হাজার ২৩৬ মাইল বা ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত জিওস্টেশনারি বা জিওসিনক্রোনাস অরবিটের কথা ভাবেন। প্রতিটি স্যাটেলাইট ১২০ ডিগ্রি করে কভার করলে ৩৬০ ডিগ্রির পুরো পৃথিবী কভার করতে দরকার তিনটি স্যাটেলাইট—এ ভাবনাও তাঁর। বর্তমানের টেলিযোগাযোগব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রয়েছে কল্পবিজ্ঞান লেখক ক্লার্ক-এর অসাধারণ কল্পনাশক্তির ওপর। রেডিও বা টেলিভিশনের স্যাটেলাইট ব্রডকাস্টিং সম্ভব হচ্ছে এই ব্যবস্থায়। ক্লার্ক-এর ভবিষ্যদ্বাণীর অনেকগুলোই ইতিমধ্যে বাস্তবে রূপ নিয়েছে। যে কারণে জিওসিনক্রোনাস অরবিটের নামকরণ করা হয়েছে ‘ক্লার্ক অরবিট’। ভবিষ্যতে যখন অন্য গ্রহে ভ্রমণ করা মানুষের অন্যতম শখ হবে, তখন ক্লার্ক অরবিট আরও পরিচিত হয়ে উঠবে।
কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের অনেক কল্পনা পরবর্তী সময়ে সত্যি হয়েছে। তিনি গত শতকের ষাটের দশকেই ধারণা দেন সামনের ৫০ বছরের সম্ভাব্য আবিষ্কার সম্পর্কে। সেগুলোর মধ্যে ছিল চালকবিহীন গাড়ি। আসিমভের ভাষ্যমতে, রোবট ব্রেইন অর্থাৎ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যে মানুষ ছাড়াই চলবে গাড়িগুলো। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে গুগল, অ্যাপল, টেসলা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে এই ধরনের চালকবিহীন গাড়ি নির্মাণ করেছে। সেদিন বেশি দূরে নেই, যখন রাস্তায় মানুষচালিত গাড়ি পাওয়াই মুশকিল হবে!