(শেষ ভাগ)
বহুমূল্য রত্ন, হীরা, সোনা, মুক্তার তৈরি গয়না, আসবাব, পোশাক-পরিচ্ছদ যত্রতত্র এলোমেলো ছড়ানো, অটোমান হেরেমের প্রতিটি কোণায় রক্ত আর লাশের ছড়াছড়ি, সবচেয়ে দামি অথচ ছিন্ন ভিন্ন বেশভূষায় সজ্জিত এক পৌঢ় নারীর রক্তাক্ত শবদেহটাই আলাদা করে নজর কাড়ছে। হ্যাঁ, ইনিই অটোমান সাম্রাজ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী সুলতানা, ওয়ালিদে কোসেম সুলতান। সম্ভবত পুরো অটোমান সাম্রাজ্যে তিনিই একমাত্র সুলতানা, যার জীবন এতটাই ঘটনাবহুল আর চ্যালেঞ্জিং ছিল যে, একটি লেখাতে কখনোই তা পুরোপুরি তুলে ধরা সম্ভব নয়। কিন্ত কী এমন ঘটেছিল যে জীবনের ৬২তম বছরে এমন বীভৎসভাবে হত্যা করা হলো তাকে?
কোসেম সুলতান যখন দেখলেন তার পুত্র ইব্রাহিম সুলতান হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারছেন না, তখন তিনি তার পুত্রকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি। আর তাই, ১৬৪৭ সালে কোসেম সুলতান এবং সালিহ পাশা দুজনে মিলে পরিকল্পনা করেন সুলতান ইব্রাহিমকে অপসারণ করার। সুলতানের বিরুদ্ধে কোসেম এবং সালিহ পাশার এই ষড়যন্ত্রের কথা সবার সামনে চলে আসে। সুলতানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের দায়ে সুলতান ইব্রাহিম শাস্তিস্বরূপ সালিহ পাশাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। আর কোসেম সুলতানকে প্রাসাদ থেকে বের করে দেওয়া হয়। তোপকাপি প্রাসাদ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর তার প্রভাব এক বিন্দুও কমেনি, বরং প্রাসাদের বাইরে থেকেও জেনিসারি ও ওলামাগণের উপর যথেষ্ট আধিপত্য বজায় ছিল। ১৬৪৮ সালে জেনিসারি বাহিনী ও ওলামাগণ সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন এবং সুলতান ইব্রাহিমকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। তোপকাপি প্রাসাদে তাকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, ওলামাগণ সেই আদেশ জারি করার ক্ষেত্রে কোসেম সুলতানের পরামর্শ চেয়েছিলেন এবং কোসেম ক্ষমতার মোহে এতটাই আবিষ্ট ছিলেন যে তাতে তিনি সায় দিয়েছিলেন।
কোসেম, সুলতান ইব্রাহিমকে হটিয়ে তারই সাত বছরের পুত্র চতুর্থ মেহমেতকে নামমাত্র সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য পরিচালনার যে স্বপ্ন দেখছিলেন, অবশেষে তা সফল করেছিলেন। চতুর্থ মেহমেত ছিলেন পূর্ববর্তী সুলতান ইব্রাহিম এবং তুরহান সুলতানের পুত্র। তাই ইব্রাহিমের মৃত্যুর পর চতুর্থ মেহমেত সিংহাসনে বসেন। কাজেই ভ্যালিদে সুলতান (রাজমাতা) পদটিতে তুরহান সুলতানের অধিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু কোসেম ভ্যালিদে সুলতান পদ থেকে অব্যাহতি না নিয়ে আরও ক্ষমতাশালী হিসেবে আবির্ভূত হলেন। চতুর্থ মেহমেতকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে সরাসরি রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন। শিশু নাতিকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যের সকল দায়িত্ব পালন করেন। শত্রুদের কখনো ক্ষমা না করলেও তিনি প্রজাদের স্বার্থে দানবীর ছিলেন। মিশরের বন্যা দুর্গতদের সাহায্য দান, মক্কার গরীব মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদান। গরিব পরিবারের মেয়েদের বিয়েতে সাহায্য প্রদান করতেন। ১৬৪০ সালে উস্কুদারে একটি মসজিদ ও স্কুল তৈরি করেন।
প্রভাবশালী এই মহিয়সী নারীর মৃত্যু ছিল মর্মান্তিক। ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সুলতানাকে ষড়যন্ত্র করে অত্যন্ত নির্মমভাবে খুন করা হয়। তুরহান সুলতান স্বামী ইব্রাহীমের মৃত্যুর জন্য কোসেমকে দায়ী করতেন। তাই ধারণা করা হয়, প্রতিশোধের স্পৃহা ও রাজমাতা হওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে তুরহান সুলতান ১৬৫১ সালে প্রাসাদের কয়েকজন খোজা ও প্রহরীর সাহায্যে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। মৃত্যুর পর তাকে তার স্বামী প্রথম আহমেদের কবরের পাশে দাফন করা হয়। ষোড়শ শতকের প্রথমভাগে হুররাম সুলতানের সময় নারী ক্ষমতায়নের যে সূচনা ঘটেছিল, কোসেম সুলতানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার ইতি ঘটে। উসমানীয় সাম্রাজ্যে আর কোনো নারী কোসেম সুলতানের মতো রাজনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। আনুমানিক ১৫৮৯ সালে জন্ম নেয়া কোসেমের মৃত্যু হয় ১৬৫১ সালে। তিনি পাঁচ শাহজাদা ও চার শাহজাদীর জন্ম দিয়েছিলেন। মৃত্যুর পর তাকে স্বামী সুলতান আহমদ খানের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।
কোসেম সুলতানকে নিয়ে তুরস্কে একটি টেলিভিশন ধারাবাহিক নির্মিত হয়, নাম ‘মুহতেশেম ইউজিয়েল : কোসেম। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে সেটি প্রচার হয়। বাংলাদেশে প্রচার হয় ‘সুলতান সুলেমান: কোসেম’ নামে। এখানে কোসেমের জীবনকে দেখানো হয়েছে তিনটি পর্যায়ে। বালিকা আনাস্তাসিয়া, যুবতী কোসেম এবং পরিণত বয়সের কোসেম সুলতানা। তিনটি পর্যায়ে অভিনয় করেছেন আনাস্তাসিয়া চরিত্রে আনাস্তাসিয়া টিসিলিম্পু, কোসেম চরিত্রে তুরস্কের জনপ্রিয় অভিনেত্রী বেরেন সাত এবং কোসেম সুলতানা চরিত্রে অভিনয় করেছেন নূরগুল।